Tuesday, May 14, 2019

ধর্ষিতার আর্তনাদ

কবর থেকে এক ধর্ষিতার আর্তনাদ।

আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম। সত্যি আমি একদম মরতে চাইনি। আমাকে সমাজ মৃত্যুবরনে বাধ্য করেছিলো। প্রতিনিয়ত ধ্বিক্কার দিতো "এই তুই মর বেশ্যা মেয়ে" বলে।

আর কিছু দিন পরই আমার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে। মা বলেছিলো এবার ভাল রেজাল্ট করলে একটা গিফ্ট দিবে। কতোবার জানতে চেয়েছিলাম মায়ের কাছে কি সেই গিফ্ট, মা বললো আগে বললে মজা থাকবে না। আমি আর কখনোই শুনবো না কি ছিল সেই গিফ্ট, আর কখনোই বলবো না মা আমার ঐ যে মেলা থেকে কিনেছি ঐ নীল ড্রেসটা খুজে পাচ্ছি না মা।

কি ছিল আমার অপরাধ? শুধু মেয়ে হয়েই জন্মেছি এই তো। আমি কি জানতাম এই পৃথিবী আমার বাসযোগ্য নয়? মা তুমি তো জানতা মা এই পৃথিবী হায়েনাদের দখলে তবুও কেন আমাকে জন্ম দিলে মা?

বিশ্বাস করো মা আমি তোমার কথা মতোই কখনো কোন ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকাই নি। ওরা প্রতিদিনই আমাকে বাজে কথা বলতো মা তুমি তো জানো। তোমার কথা মতোই আমি সব নিরবে সয়ে গেছিলাম। আমি কতোবার নিরবে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম তবুও তোমার কথা মনে পরতেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।

আমার তো সেদিন এই পৃথিবীতে আসা উচিত ছিলে যেদিন আমি মুক্ত ভাবে বাঁচতে পারতাম। বড্ড ভুল সময়ে এসে পড়েছি না মা? আমার জন্য তোমাদেরও কতো কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।

ওরা আমায় জোর করে তুলে নিেয় গিয়েছিলো। আমি কতোবার যে ঈশ্বরকে ডেকেছি, তিনিও আমার কথা শুনলেন না, শুনলেন ঐ লম্পট ছেলেদের কথা। আমি তখনি মরে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু শুধু তোমায় শেষ বারের মতো দেখার ইচ্ছে হতেই বেঁচে ছিলাম। আমি জীবিত থেকেও প্রতিটা মুহুর্তে নিজেকে নিজের ঘেন্না হতো, মনে হতো আমি প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মরে যাচ্ছি।

সেদিন যখন পাড়ার লোকজন তোমার দিকে আঙুল তুলে বললো, শুধু তোমার মেয়েকেই কেন ধর্ষণ করলো আরো তো মেেয় আছে নাকি, মেয়ে সমাজের মান সম্মান সব ডুবালো ছেঃ ছেঃ ছেঃ " বিশ্বাস করো আমার কেন যেন মনে হলো আমাকে ঐ লম্পট ধর্ষণ করেছে একবার আর পুরো সমাজ করেছে বারবার।

মা তোমার স্বপ্ন ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবা, দেশের সেবা করবো আমি আর আজ সেই দেশই আমাকে থু থু দিচ্ছে। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে।

এখানে খুব শান্তিতে আছি আমি। মুক্তভাবে কথা বলতে পারি হাসতে পারি লাফাতে পারি। কেউ বলে না এই তুই মেেয় এইসব তোর মানায় না। কোন চিন্তা হয় না যে কালও ঐ বখাটেগুলো রাস্তায় দাড়িয়ে থাকবে বলে। আমি খুব শান্তিতে আছি খুব স্বাধীন আমি এই কবরে।

ভাইটা আমার রোজ আমার কবরের সামনে এসে কাঁদে। আমায় ডাকে। আমি তো কলংকিনী মা, আমি কীভাবে কোন মুখে কথা বলবো ওর সাথে। তুমি ওকে মানা করে দিও কিন্তু। ও নাকি আর কখনো দুষ্টামি করবে না খুব ভদ্র হয়ে যাবে আমি ফিরে আসলে। আমি তো থাকতেই চেয়েছিলাম, সমাজ তো আমাকে রাখতে চায় নি ভাই।

আর বাবাকে বলো শুধু শুধু টাকা খরচ করে মামলা করে লাভ নেই। আমি সব দেখতে পাচ্ছি সব শুনতে পাচ্ছি। ওরা খুব ভালো আছে ওদের কিচ্ছু হবে না মা।

ভালো থাকুক দেশ ভালো থাকো তুমিও মা। অটুট থাকুক সমাজের সম্মান প্রতিটি ধর্ষিতার চাপা কান্নায়।
আমি এবার শান্তিতে ঘুমাই।

Monday, May 13, 2019

প্রতীক্ষার অবসান

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি মানুষ....

তা তো বুঝতেই পারছি। আমি তো বলি নি আপনি দাঁড়কাক কিংবা কোলাব্যাঙ।

কীসব বিচ্ছিরি কথাবার্তা....

কথার প্রারম্ভিকা এমন উল্টাপাল্টা হলে তো এসব শুনতেই হবে। পৃথিবী বদলায়, কতো গৃহবাসী হয় সন্ন্যাসী, কত ভেষজবিদ্যার সফল প্রয়োগ করেও ঝুলে যায় কপোলের আবরিত  আভরণ, তবুও পৃথিবীর কিছু কুনোব্যাঙের কোনো পরিবর্তন নেই। এরা একই সুরে ডেকে যায় আজীবন।

কোলাব্যাঙ থেকে এখন কুনোব্যাঙ হয়ে গেলাম?

তো কী? পুরনো খবরের কাগজের মতো ফেলে রাখা কাউকে এতোবছর পর তোমার মন খুঁজে পেলো কীভাবে? কোথায় লুকিয়ে ছিলে শুনি ?

যে মনের ভেতর ছটফট করে সবসময় তাকে খুঁজে পেতে হয় না।

এতো সাহিত্য বুলিয়ো না। ওসব সাহিত্যই আমার জীবনটা হাহাকারে ভরিয়ে দিয়েছে।  কবিতা গিলিয়ে গিলিয়ে আমাকে আজীবন দাসত্ব গ্রহণ করিয়েছো। আজ মনে হচ্ছে, সবই ভুল ছিল।

এক জীবনে এক বুক হাহাকার না  থাকলে সেটা জীবন নাকি? এতো বছরেও বুঝতে পারলে না তুমি... স্কেল মেপে সঠিকে নয়, ভুলই আমাদের বেঁচে থাকার তৃষ্ণা জোগায়।

তো আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ফোন করেছো তো? দাও সান্ত্বনা.... গলা ভার করে বলো, নশ্বর পৃথিবীতে সবাইকেই চলে  যেতে হবে । কষ্ট পেয়ো না। ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্য করেন।

ঈশ্বর ছাড়া আমাদের শূন্য ঝুলিওয়ালাদের আর কেইবা আছে?

ঈশ্বর! আমাকে ঈশ্বরের কথা বোলো না।  যখন ঈশ্বরকে ডেকে ডেকে গলা শুকিয়েছি, নোনাজলে ডুবিয়েছি  জোড়া-চোখ, বালিশে চাপিয়েছি আর্তনাদ, ঈশ্বর তখন কোথায় ছিলেন? তাঁর জন্যই আমাকে দ্বিচারিণী হতে  হল।

আচ্ছা, সেসব পরে শুনবো। এখন তুমি কেমন আছ?

খুব ভালো। শীতের পাতাঝড়া  গাছের মতো, দমকা হাওয়ায় নিভন্ত প্রদীপের মতো ভালো আছি।

খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে সেদিন আসতে পারি নি। এত বছর পরে তোমার দেখা পাবো, নোনাজলের পর্দা দিয়ে তোমার চোখে তাকানোর সাহস আমার নেই বলে আসা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।

হুম, তুমি তো জ্বলন্ত অগ্নি নয়, পুড়ে যাওয়া ভস্ম দেখতে ভালোবাসো।

সেসব ছাড়ো, তোমাকে ও ভিটায় আর থাকতে হবে না। আমরা অন্য কোথাও চলে যাবো।

স্বামী মরে গেলে সে ভিটা বুঝি আর আমার ভিটা নয়? আর এত বছর পর বিধবার প্রতি দয়া দেখানোর দুঃসাহস তুমি কোথায় পেলে?

দ্বিচারিণী হয়ে সংসার গ্রহণ করে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করতে পেরেছো কখনো? শরীরের আর মনের ভেতর মহাকাশ সমান দূরত্ব নিয়ে তথাকথিত সংসার হয়, ভালোবাসা নয়।

এতোবছর পর তোমার ভালোবাসার কথা মনে পড়লো? নিজেকে একবারও ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে না তোমার?

একজন ভবঘুরে মাতালের চেয়ে ভেবেছি ঐ সংসারী জীবনই তোমার সুখের হবে। তোমায় পাওয়াটাই আমার কাছে মূখ্য ছিল না  শৈলী, তোমার সুখে থাকাটাই ছিল আসল। আমি যতদিনে অন্যকিছু বুঝতে পারি ততদিনে তুমি সামাজিক কারাগারে বন্দি।

আমায় কখনো ডেকেছিলে ফেরার আমন্ত্রণে?

বুকের ভেতর দুঃখের ঝরনাধারা বইয়ে দিয়েও আমি তোমায় সূর্যের মতো হাস্যোজ্জ্বল দেখতে চেয়েছিলাম। আমি বুঝি নি, মৃত্যু উপত্যকায় সূর্যের ঐ হাসি কেবল উপহাস ছাড়া কিছু নয়।

তো ভবঘুরে মাতাল মহাশয় কি এখন মাতাল হয়ে আমাকে ফোন করেছে নাকি হৃদয়ের তীব্র ক্ষতের বেদনা ফোন তুলে দিয়েছে হাতে?

এখন সে ক্ষতে নুন ছিটিয়ে খুব সুখ পাও?

পড়ন্ত বয়সে ক্ষত ছাড়া হৃদয়ে আর কীইবা থাকে। স্মৃতিগুলোকে আজ বিশাল বিশাল দুঃখশালা মনে হয়।

স্মৃতি সবসময়ই হরেক রকম কষ্টের অবতারণা করে, হোক সে সুখের কিংবা দুঃখের। তুমি সেটাও ভুলে গেলে শৈলী?

আমি ভুলে গেলে ফোন রিসিভ করেই তোমার গলাটা কী করে চিনেছি বলো? নারীকে ভোলানো যায়, ভুলানো যায় না।

আজ রাখছি তাহলে। তোমার ঠিক করে রাখা ৯ই ফাল্গুনে দুজন নাহয় বাকি কথা বলবো।

কিন্তু তোমার সংসার? তোমার স্ত্রীকে কী বলবে?

অবিবাহিত পুরুষের স্ত্রী থাকে না। কারো জন্য জমিয়ে রাখা আবেগে আমি অন্য কাউকে ভাগ দিতে পারি নি। এটা আমার ব্যর্থতা হয়তো।

ব্যর্থ মানুষ, মাতাল মানুষ। আমায় পেয়ে তোমার কবিতা লেখায় আবার ভাটা পড়বে না তো?

পড়ুক না হয় ভাটা। যে সাগরে ভাটা নেই সে সাগর জোয়ার থেকে বঞ্চিত থেকে যায় আজীবন।

© রাজীব নন্দী