শ্রাবণী। সদ্য কলেজের চৌকাঠ পার হইয়া মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হইয়া অষ্টাদশী বনে গমন করা বালিকা। নাহ, তাহাকে আর যাহাই হোক এখন বালিকা বলা চলে না। দীর্ঘ দশ বছর পাড়ি দিয়া কি করিয়া যে বালিকা হইতে রমণী হইয়া উঠিয়াছে আমি তাহা ভাবিয়া কূল পাই না। ওর মাতুলালয় আমাদের বাড়ির ঠিক উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে। দশ বছর পূর্বে সেই ছোট্টবেলায় চোখকে উপেক্ষা করিয়া গেলেও আজ তাহার উপর হইতে চোখ ফিরানো দুঃসহ কর্ম বটে।
আকাশ হইতে তারা খসিয়া পড়ে, বৃক্ষ হইতে ফল ছুটিয়া পড়ে আর তাই আমিও এই অষ্টাদশীর প্রেমে না পড়িয়া পারিলাম না। তাহা না হইলে যে প্রকৃতির সহিত বিরুদ্ধাচারণ হইবে। কি করিয়া তাহাকে ইমপ্রেস করিতে হইবে তাহা এতোকাল ইমেপ্রেম টেলিফিল্মের রোমান্টিক মুভি দেখিয়াও শিখিয়া লইতে ব্যর্থ হইয়াছি। আমি যে এই অষ্টাদশীকে বড্ড ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। যাহাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলিলে হয়তো যথার্থ বলা হইবে। তাই গুগোল কিংবা ভূগোল যাহাই হোক তালাশ করিয়া উপায় আমাকে বাহির করিতেই হইবে।
ছোট বোনকে গুপ্তচর নিয়োগ করিয়া জানিয়া লইলাম যে, এই অষ্টাদশী আর যাহাই হোক অন্যদের হইতে ঢেড় আলাদা। তাহার সহিত আমার প্রেম কাহিনি খুব সহজেই ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ এই লাইনে পৌঁছাইয়া যাইবে তাহাও ভাবি না। বহু কাঠখড় পুড়িয়া জলবায়ু চুক্তির অবমাননা করিয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ খানিকটা বাড়িয়া যাইবে তাহা প্রথমেই অনুমান করিয়া লইয়াছি। ভিতরে ভিতরে ইহাও আত্মস্থ করিয়া লইয়াছি যে, মৌচাকের সেই বন্ধুর রাস্তা পদব্রজে হাঁটিয়া তাহার মেডিকেল কলেজের সামনে যদি রোমিও সাজিতে হয় তাও সাজিবো। ভালোবাসার জন্য যুগে যুগে কত মহান প্রেমিক কত কি করিয়াছেন আমি তাহাদের আইডল মানিয়া লইলাম। তবে এখন কিছু একটা দিয়া তো শুরু করিতে হইবে। এতো ভালোবাসা বুকে লইয়া ঘুরিবো অথচ সে জানিতেও পারিবে না তাহা কি করিয়া হয়।
তাই চিঠি লিখিলাম,
“হে ডাক্তারনী,
এনাটমি পড়িতে পড়িতে জীবনটাকে যখন শক্ত হাড্ডির মতই নীরস মনে হইবে তখন ভাবিও কেহ একজন তোমার পাশে খেঁজুর গাছ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।
ফিজিওলজি পড়িতে পড়িতে যখন তোমার নিজের ফিজিওলজি ব্যর্থ হইয়া পড়িতে চাইবে তখন ভাবিও কেহ একজন তোমার পাশে আখ গাছ হইয়া দাঁড়াাইয়া রহিয়াছে ।
আর ওপেন হার্ট সার্জারি প্রাকটিস করিবার জন্য যদি কোন রোগী খুঁজিয়া না পাও তবে ভাবিও কেহ একজন তাহার হার্ট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে।”
চিঠিখানা লিখিয়া গুপ্তচর মারফত শ্রাবণীর তালুদাবা করিয়া দিলাম। পরদিন ফিরতি চিঠি আমার হস্তে আসিয়া পড়িল যাহাতে লিখা রহিয়াছে-
“হে খেঁজুর গাছ, আখ গাছ ও হার্টের রোগী,
আমি আপনার লেখার মুগ্ধ। শুধু চিঠি পড়িয়াই এতোটা বিমোহিত হইলাম, আপনি উপন্যাস লিখিলে তাহা পড়িয়া আমার কি করুণ অবস্থা হইতো তাহা কেবল ঈশ্বরই জানে। শুনে রাখেন, আমি অত সহজে পটিয়া যাইবার পাত্রী নহে। তবে একখানা শর্ত দিলাম আপনাকে, আকাশে যখনই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি দেখা যাইবে তখন যদি একখানা ডিঙ্গি নৌকা লইয়া মালিবাগ-মৌচাকের রাস্তায় হাজির হইয়া আমাকে পাড় করিয়া কলেজে পৌঁছাইয়া দিতে পারেন তবেই আমি বিষয়খানা ভাবিয়া দেখিবো।”
আমি অতঃপর বলিলাম, ইহা আর এমন কি? তুমি চাইলে উত্তর কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রকে মিলাইয়া দিতে পারি, বন্ধুর সম্পর্ক তৈরি করিয়া দিতে পারি ভারত আর পাকিস্তানের মইধ্যেও। তুমি চাইলে অং সাং সুচি’র বুকে ঢালিয়া দিতে পারি এক ড্রাম মানবতা, তুমি চাইলে চালের বাজারে শায়েস্তা খাঁ’র আইন চালু করিয়া দিতে পারি। আর তুমি কিনা সামান্য এইটা চাইলা!
ফিরতি বার্তায় অষ্টাদশী বলিল, বাহ! আমি পটিয়া গিয়াছি হে। তবে আমি অতোকিছু চাহিবার পাত্রী নই। আমি চাই আপনি ইয়ে মানে তুমি সব সময় আমার চক্ষুর সম্মুখ জুড়িয়া থাকো। পড়িতে বসিলেও যাহাতে তোমায় দেখিতে পাই, ইচ্ছে হইলেই ছুঁইয়া দেখিতে পারি। আমার সহিত তুমি আমার ক্লাসে যাইবা আবার ফিরিয়া আসিবা। আমার পড়ার টেবিল থেকে বেডরুম সবখানেই তোমার প্রবেশাধিকার দেওয়া হইবে।
এহেন চিঠি দেখিয়া আমি বারবার চক্ষু ডলিতে লাগিলাম; আমি কি ঠিকঠাক পড়িতেছি কিনা। তাই দেরি না করিয়াই জানিতে চাহিলাম, “সেটা এক্ষুনি কি করিয়া সম্ভব হে? তবুও আমার তর সহে না। উপায় বলিয়া দাও কি করিয়া তাহা সম্ভব হইবে?”
অষ্টাদশী বলিল, সদ্য এনাটমী পড়িতে শুরু করিয়াছি। বাজারে খুঁজিয়াও ভালো মানের কঙ্কাল কিনিতে পারি নাই। তোমার বডির কংকালতন্ত্রটা আমাকে দিয়া দিলেই একটা কঙ্কালের অভাব পূরণ হইবে বলিয়া অনুমান করি। এতো ভালোবাসো যেহেতু পারিবে কি তোমার কঙ্কালখানা দিতে? যদি পারো তবে চিঠি দিয়া জানাইবে কিন্ত। তবেই সবসময় তুমি আমার সহিত থাকিতে পারিবে, ব্যস?
অতঃপর আমি চিঠি লিখিবার জন্য কলম কিংবা ডায়েরি কিছুই খুঁজিয়া পাই নাই। আর আমাকেও সেই অষ্টাদশীর চৌ-হদ্দিতে কখনো খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।
- রাজীব নন্দী
০৬-১০-২০১৭