Thursday, February 21, 2019

একজন স্বপ্নযাত্রী: ইতিহাস, বাস্তবতা ও হাস্যরসের মিশেল

ছোটবেলার ভাদাইম্মা ফরিদ যখন কালের প্রবাহে ল্যাংটা বাবা রূপে তুর্যের সামনে আবির্ভূত হয় তূর্য তখন হতভম্ব হয়ে যায়। তার এই মুখোশহীন ভণ্ডামির কারণ জানতে চাইলে গোপনে বলে, “কী করুম ভাইজান - পুরো দেশটাইতো এহোন ল্যাংটা। একটু চোখ বুইজা ভাবলে অন্তরচক্ষু দিয়া হেই ল্যাংটা লেবাস আমনেও দেখতে পাইবেন। আমাগো দেশের রাজনৈতিক নেতারা তো অনেক আগেই দেশটারে বেশ্যা বানাইয়া রাখছে। যে যার মতো কইরা ভোগ করে।”

এটুকু পড়েই বুঝা যায় লেখকের রাষ্ট্রের প্রতি অনুরাগ। পুরো উপন্যাসেই লেখক নিজের কথাগুলোকে চরিত্রের মুখে বুলি হিসবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান রাষ্ট্রের দিকে তাকালে হয়তো যেকেউই এটা দেখতে পাবে।

তবে এই দায়ভার কি শুধুই রাষ্ট্রের নেতাদের নাকি সাধারণ জনগণের চরিত্রেও সমস্যা আছে? সেটাই বলছেন অন্যখানে । "মানুষ ও পশুর মধ্যে যেমন ভালোবাসা বিনিময় হয় তেমনি চরিত্রেরও বিনিময় হয়। কোনো কোনো সময় মানুষ পশুর চরিত্র ধারণ করে।"

সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেটা হল বেকারত্বের আর্তনাদ। লেখক কখনো সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন বেকারদের আশ্রয়স্থল মেস লাইফের হাসি কান্নার উপাখ্যান যা তার নিজের জীবন থেকেই নেয়া নির্দ্বিধায় বলা যায়। নয়তো এতো সূক্ষ্ণ বর্ণনা কল্পনা থেকে টেনে আসা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।

"আমাদের দেশে আবার মানুষের নাম তার কর্মের উপর ভিত্তি করে বিকৃত হয়ে যায়। অফিসের বড় কর্তাকে আমরা রহিম সাহেব বললেও ঘরের কাজের ছেলের নাম হয় রহিম্মা।" 

বর্ণনায় কখনো কখনো মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন। দাড়োয়ানের স্যালুট দেয়ার বর্ণনায় লিখেছেন, "দাড়োয়ান তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাম পা-টা একটু সামনে টেনে ডানহাত কপালে ঠেকিয়ে, ডানপা উঁচুতে উঠায়ে মুহূর্তেই সে পা ফ্লোরে ফেলে দাড়াম করে শব্দসহকারে স্যালুট করে।"

উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চরিত্রকে আরো বাস্তব করে তোলে। দাড়োয়ানকে উপন্যাসের নায়ক তূর্য যখন তার স্যার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তার উত্তর ছিল, 'আরেহ মিয়া আমাগো মতো লমা-ছমারে কি বড় সাহেবরা অইসব কইয়া যায়।' জন্মসূত্রে ভোলার বাসিন্দা হওয়ায় ভোলার আঞ্চলিক ভাষাটাকেই তিনি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন উপন্যাসে। সেই শব্দভান্ডারের কলসি থেকে ঢাকনা তুলে তা উম্মুক্ত করে দেন সবার জন্য।

উপন্যাসটি এই কারণে আরো গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে একটি পুরাণ ঢাকার একটা বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরেছেন। আশি নব্বইয়ের দশকে যখন এই টাইটানিকসম জাহাজ, জিরাফের মতো মাথা উঁচু করা ভবন এতোটা জনপ্রিয় হয় নি তখন সদরঘাটে ভাসমান হোটেল ছিল। তার উপন্যাসের শুরুতেই সেই ইতিহাস ফুটে ওঠে পাঠকের কাছে। আমার কাছে এই তথ্য আগে সম্পূর্ণ অজানা ছিল।

আগের উপন্যাসগুলো পড়ার সুবাদে বলতে পারি লেখকের ভেতর দেশপ্রেম প্রগাঢ়। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে দেশপ্রেমকে স্থান ছেড়ে দেন।

উপন্যাস থেকে দুটো লাইন কোট করে দিতে চাই পাঠকদের জন্য।
"আসার সময় শাঁখারি বাজার কালি মন্দিরে পুজো দিয়ে আসলেন চান্দুলাল কাকা তূর্যের নামে মানতের। ভালোবাসার কোনো দেশ কাল পাত্র ধর্ম হয় না। ভালোবাসাকে কেবল একটি নিয়ামকেই মাপা যায় আর সেটা হল ভালোবাসা।" এটা আমার কাছে দারুণ লাগছে। চান্দুলাল চরিত্রটাকে এক কথায় বলা যায় মানবতার ফেরিওয়ালা।

আরেকটি কোট  হল-
"পুলিশে দিলে আমিও ওগোরে কইয়া দিমু দোকানে কোন কোন মালের লগে ভেজাল মিশাইয়া মাল বেচেন। তখন বুঝবেন আমি বড় চোর নাকি আপনি!" ফরিদের উক্তি। ফরিদ বাধ্য হয়েই খারাপ পথে হাঁটে। মেসের খরচের জন্য চুরি করে সে। কিন্তু সে চুরি তার কাছে মালিকের চুরির তুলনায় সামান্যই মনে হয়।

পুরো উপন্যাসটাই নায়কের কল্পনার ভেতরে ঘুরপাক খেয়ে যখন শেষ হবে তখন পাঠকের মাথায়ও ঘুরপাক খাবে।
"একদিন একরাতে করেছি প্রেমের সাথে খেলা
একরাত একদিন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা।
একদিন একরাত তারপর প্রেম গেছে চলে
সবাই চলিয়া যায় সকলের যেতে হয় বলে।"

পাঠ শেষে এটুকুই বলবো, লেখক নিজের সাথে নিজেই প্রতিযোগিতা করে দিনদিন উতরে যাচ্ছেন। আরো সময় এবং ধৈর্য নিয়ে লিখলে হয়তো আরো ভালো লেখনী পাবে পাঠক। ঔপন্যাসিকের জন্য শুভ কামনা।

উপন্যাস: একজন স্বপ্নযাাত্রী
লেখক: মাহববু-উল-আলম চৌধুরী
প্রকাশনী : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রকাশকাল : ২০১৯ বইমেলা

রাজীব নন্দী
২১-০২-২০১৯

No comments:

Post a Comment