সদ্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে জুটেছি। ব্যাচেলর ছেলেমেয়েরা যে এতটা অবহেলিত এটা গ্রামে থেকে কখনো মনে হয়নি। এখানে একদল ঘুষখোর, প্রতারক, জালিয়াতি, চোরাকারবারি বিবাহিতও সহজে বাড়ি ভাড়া পায় কিন্তু নিরীহ শান্ত-শিষ্ট ব্যাচেলররা বাড়ি ভাড়া পায় না। ভাগ্যিস এক বন্ধুর মামা মন্ত্রীকে দিয়ে বাড়িওয়ালাকে ফোন করিয়েছিল নয়তো এ রুমেও পেট উঁচু করে শুয়ে থাকার সুযোগ পেতাম না।
আমি যেখানটায় উঠেছি সে বিল্ডিংটা সাত তলা। আমি থাকি পাঁচ তলায়। পুরো বিল্ডিংয়ে যত মানুষ আছে তা আমাদের পুরো এক গ্রামের সমান হবে। গ্রামের সবার বাড়ির উঠোন থেকে রান্নার উনুন সবই আমার পরিচিত। কিন্তু প্রায় এক বছর থেকেও এখানে তা সম্ভব হয় নি। আমার পাশের রুমের প্রতিবেশী আন্টিকে প্রথম দেখেছি প্রায় আট মাস পর। ভাগ্যিস দেখা হয়েছিল নয়তো প্রতিবেশী হিসেবে মানুষ থাকে নাকি ভূত তা আমি কখনো জানতেও পারতাম না। আর এসব না জানার পেছনে বড় কারণ আমার অন্তর্মুখী স্বভাব। নিজ থেকে যেচে আমি কারো সাথে কথা বলি না। আর সেজন্যই বোধহয় নিচতলা থেকে সাত তলা পর্যন্ত আমার প্রতিবেশী, সুখে দুঃখের সাথীরা অচেনাই রয়ে গেল। কিন্ত এভাবে আর কত দিন! এবার জাগো, মানুষের সাথে মিশতে শিখো। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নাও, তারা খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে সেসব দেখে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসো, প্রতিবেশী কেউ টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে কিনা দেখো। নিজেকেই নিজে বলতে লাগলাম।
তাই অনেক ভেবেচিন্তে মনস্থির করলাম, আজ প্রতিবেশীদের খোঁজ খবর জানবো। প্রতিবেশী হিসেবে এ দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। সমাজ বইতে কতবার করে এসব পড়েছি ‘প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ তা ভুলে গেলে তো হবে না।
নিচতলায় গিয়ে কলিংবেল দিতেই মধ্যময়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিল। বললাম, আমি এই বিল্ডিংয়েই থাকি, আপনাদের প্রতিবেশী। ভালো আছেন আপনারা সবাই? ফ্যাল ফ্যাল করে এমনভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন, টিভি সিরিয়ালের মেগা এপিসোড চলতেছে। দুই তলায় কলিংবেল দিতেই একটা পিচ্চি দরজা খুলেই বলল, কাকে চান? আমি বললাম, বাবু আমি তোমার প্রতিবেশী। চকোলেট খাবা? চলো তোমাকে চকোলেট কিনে দিবো। ত্যাঁদড় পিচ্চি, ‘মা ছেলেধরা এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে’ বলেই চিৎকার করে উঠল। ওর মা আসার আগেই আমি তিন তলায় চলে এলাম।
দরজায় টোকা দিতেই তা খুলে ধরল একটা ভয়ংকর সুন্দর মেয়ে। কাকে চাচ্ছেন জিজ্ঞেস করতেই বললাল, আপনাকে চাই। আমি পাঁচতলায় থাকি। একই জায়গায় থাকি অথচ আগে কখনো কথাবার্তা হয় নি তাই পরিচিত হতে এলাম, সুখ দুঃখের খবর জানতে এলাম। ওমা, মেয়েটা চোখমুখ লাল করে ধমক দিয়ে বলল, ফাইজলামি করার জায়গা পান না? ব্যাচেলর মেয়ে দেখলেই ফ্ল্যার্ট করতে ইচ্ছে করে? যত্তসব! বলেই ধিরিম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
হচ্ছে কী এসব! এরা কি ছোটবেলায় সমাজ বইতে ‘প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ পড়ে নি। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিতে গেলেও সন্দেহ করে। অথচ গ্রামে আমরা এ মাথা থেকে কুক দিলে ও মাথার লোক চলে এতো। শেষবারের মতো গেলাম সাততলায়। উঁচু তলার মানুষের মনও বোধহয় উঁচু হবে। কলিংবেলের শব্দ শুনেই সবাই মিলে একসাথে দরজা খুলেই বলল, আসুন আসুন। ভেতরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল, বাসা চিনতে সমস্যা হয় নি তো। আমি মুচকি হেসে বললাম, না না সমস্যা হবে কেন! কী অমায়িক ব্যবহার! উঁচু তলার মানুষ সত্যিই উঁচু হয় তা আজ প্রমান পেলাম। একটু পর ভেতর থেকে কাজের বুয়া বের হয়ে বলল, "এইদিকে আহেন, সব ঠিকঠাকই আছিল তয় হঠাৎ কইরা কী যে অইল বুঝতে পারতেয়াছি না।" বলতে বলতে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। আমি এতক্ষণে বুঝলাম তারা আমাকে গ্যাসের চুলা মেরামত করার লোক ভেবেছে। আমি বললাম, "আপনারা যা ভাবছেন আসলে আমি তা নই, আমি পাঁচ তলায় থাকি আপনাদের প্রতিবেশী। পরিচিত হতে এলাম।" এইবার কাজের মহিলা বলে উঠল, "খালাম্মা এইতের ভাব তো ভালা দেহি না। আগে কোনো দিন তো দেহি নাই। কীসের পাঁচতলায় থাকে। কোনো ধান্ধা আছে।" বুঝলাম, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। চিকনে বের হয়ে এলাম।
রুমে ঢুকে ফ্যানের নিচে মাথা দিয়ে বসে আছি। আধা ঘণ্টা পর দরজা টোকার শব্দ শুনি। দরজা খুলে দেখি প্রায় বিশ ত্রিশ জন লোক দাঁড়ানো। তাদের ভেদ করে সামনে আসল, বাড়িওয়ালা। আমি নাকি ছেলেধরা, ইভটিজার এবং চোর। সবাই এমনভাবে তাকাচেছ মনে হচ্ছে যেন আমাকে প্যারাসিটেমলের মতো গিলে খাবে । বাড়িওয়ালা বলল, আমি সিসি ক্যামেরায় সব দেখেছি। একটু পর আসল পুলিশ। আমি যতই বলি আমি প্রতিবেশিদের খোঁজ নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম, অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমার কথা কারোই কানে যাচ্ছে না। প্রতিবেশির প্রতি বেশি কেয়ারিং হতে গিয়ে এত ডেয়ারিং কিছু ঘটে যাবে তা আমার সরল মনের জানা ছিল না। এবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে জীবনে আর কখনো প্রতিবেশীর খবর নিতে যাবো না।
~ প্রতিবেশীর প্রতি বেশি কেয়ারিংয়ের একদিন
© রাজীব নন্দী
বিচ্ছু || যুগান্তর, ২৫-০৮-২০১৯
আমি যেখানটায় উঠেছি সে বিল্ডিংটা সাত তলা। আমি থাকি পাঁচ তলায়। পুরো বিল্ডিংয়ে যত মানুষ আছে তা আমাদের পুরো এক গ্রামের সমান হবে। গ্রামের সবার বাড়ির উঠোন থেকে রান্নার উনুন সবই আমার পরিচিত। কিন্তু প্রায় এক বছর থেকেও এখানে তা সম্ভব হয় নি। আমার পাশের রুমের প্রতিবেশী আন্টিকে প্রথম দেখেছি প্রায় আট মাস পর। ভাগ্যিস দেখা হয়েছিল নয়তো প্রতিবেশী হিসেবে মানুষ থাকে নাকি ভূত তা আমি কখনো জানতেও পারতাম না। আর এসব না জানার পেছনে বড় কারণ আমার অন্তর্মুখী স্বভাব। নিজ থেকে যেচে আমি কারো সাথে কথা বলি না। আর সেজন্যই বোধহয় নিচতলা থেকে সাত তলা পর্যন্ত আমার প্রতিবেশী, সুখে দুঃখের সাথীরা অচেনাই রয়ে গেল। কিন্ত এভাবে আর কত দিন! এবার জাগো, মানুষের সাথে মিশতে শিখো। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নাও, তারা খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে সেসব দেখে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসো, প্রতিবেশী কেউ টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে কিনা দেখো। নিজেকেই নিজে বলতে লাগলাম।
তাই অনেক ভেবেচিন্তে মনস্থির করলাম, আজ প্রতিবেশীদের খোঁজ খবর জানবো। প্রতিবেশী হিসেবে এ দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। সমাজ বইতে কতবার করে এসব পড়েছি ‘প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ তা ভুলে গেলে তো হবে না।
নিচতলায় গিয়ে কলিংবেল দিতেই মধ্যময়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিল। বললাম, আমি এই বিল্ডিংয়েই থাকি, আপনাদের প্রতিবেশী। ভালো আছেন আপনারা সবাই? ফ্যাল ফ্যাল করে এমনভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন, টিভি সিরিয়ালের মেগা এপিসোড চলতেছে। দুই তলায় কলিংবেল দিতেই একটা পিচ্চি দরজা খুলেই বলল, কাকে চান? আমি বললাম, বাবু আমি তোমার প্রতিবেশী। চকোলেট খাবা? চলো তোমাকে চকোলেট কিনে দিবো। ত্যাঁদড় পিচ্চি, ‘মা ছেলেধরা এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে’ বলেই চিৎকার করে উঠল। ওর মা আসার আগেই আমি তিন তলায় চলে এলাম।
দরজায় টোকা দিতেই তা খুলে ধরল একটা ভয়ংকর সুন্দর মেয়ে। কাকে চাচ্ছেন জিজ্ঞেস করতেই বললাল, আপনাকে চাই। আমি পাঁচতলায় থাকি। একই জায়গায় থাকি অথচ আগে কখনো কথাবার্তা হয় নি তাই পরিচিত হতে এলাম, সুখ দুঃখের খবর জানতে এলাম। ওমা, মেয়েটা চোখমুখ লাল করে ধমক দিয়ে বলল, ফাইজলামি করার জায়গা পান না? ব্যাচেলর মেয়ে দেখলেই ফ্ল্যার্ট করতে ইচ্ছে করে? যত্তসব! বলেই ধিরিম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
হচ্ছে কী এসব! এরা কি ছোটবেলায় সমাজ বইতে ‘প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ পড়ে নি। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিতে গেলেও সন্দেহ করে। অথচ গ্রামে আমরা এ মাথা থেকে কুক দিলে ও মাথার লোক চলে এতো। শেষবারের মতো গেলাম সাততলায়। উঁচু তলার মানুষের মনও বোধহয় উঁচু হবে। কলিংবেলের শব্দ শুনেই সবাই মিলে একসাথে দরজা খুলেই বলল, আসুন আসুন। ভেতরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল, বাসা চিনতে সমস্যা হয় নি তো। আমি মুচকি হেসে বললাম, না না সমস্যা হবে কেন! কী অমায়িক ব্যবহার! উঁচু তলার মানুষ সত্যিই উঁচু হয় তা আজ প্রমান পেলাম। একটু পর ভেতর থেকে কাজের বুয়া বের হয়ে বলল, "এইদিকে আহেন, সব ঠিকঠাকই আছিল তয় হঠাৎ কইরা কী যে অইল বুঝতে পারতেয়াছি না।" বলতে বলতে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। আমি এতক্ষণে বুঝলাম তারা আমাকে গ্যাসের চুলা মেরামত করার লোক ভেবেছে। আমি বললাম, "আপনারা যা ভাবছেন আসলে আমি তা নই, আমি পাঁচ তলায় থাকি আপনাদের প্রতিবেশী। পরিচিত হতে এলাম।" এইবার কাজের মহিলা বলে উঠল, "খালাম্মা এইতের ভাব তো ভালা দেহি না। আগে কোনো দিন তো দেহি নাই। কীসের পাঁচতলায় থাকে। কোনো ধান্ধা আছে।" বুঝলাম, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। চিকনে বের হয়ে এলাম।
রুমে ঢুকে ফ্যানের নিচে মাথা দিয়ে বসে আছি। আধা ঘণ্টা পর দরজা টোকার শব্দ শুনি। দরজা খুলে দেখি প্রায় বিশ ত্রিশ জন লোক দাঁড়ানো। তাদের ভেদ করে সামনে আসল, বাড়িওয়ালা। আমি নাকি ছেলেধরা, ইভটিজার এবং চোর। সবাই এমনভাবে তাকাচেছ মনে হচ্ছে যেন আমাকে প্যারাসিটেমলের মতো গিলে খাবে । বাড়িওয়ালা বলল, আমি সিসি ক্যামেরায় সব দেখেছি। একটু পর আসল পুলিশ। আমি যতই বলি আমি প্রতিবেশিদের খোঁজ নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম, অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমার কথা কারোই কানে যাচ্ছে না। প্রতিবেশির প্রতি বেশি কেয়ারিং হতে গিয়ে এত ডেয়ারিং কিছু ঘটে যাবে তা আমার সরল মনের জানা ছিল না। এবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে জীবনে আর কখনো প্রতিবেশীর খবর নিতে যাবো না।
~ প্রতিবেশীর প্রতি বেশি কেয়ারিংয়ের একদিন
© রাজীব নন্দী
বিচ্ছু || যুগান্তর, ২৫-০৮-২০১৯
No comments:
Post a Comment