Tuesday, October 22, 2019

কষ্ট হচ্ছে হোক


এই যে, তোমার পাশে বসে কত অপরিচিত লোক ভ্রমণ করে,
কোথায় যাবেন? বাসা কোথায় ? বলে কত খোশ গল্প করে,
দশ টাকার বাদাম কিনে তোমার দিকে ঠোঙা বাড়িয়ে ধরে-
তুমি মুচকি হেসে না বলে দাও।
আমি তোমায় ভালোবেসেও তা পারি না।

এই যে, ভিক্ষুকটা ‘সাহায্য করেন’ বলে ভিক্ষা চায়
তার বাড়িয়ে দেয়া হাতে তোমার সাহায্যের হাত রাখো,
কখনো সখনো 'মাফ করেন' বলে তার কথার উত্তর দাও।
অথচ আমিও ভিক্ষুকের মতো দুহাত বাড়িয়ে ভালোবাসা চাইলে মুখ ফিরিয়ে নাও।

এই যে, অসুস্থ কুকুরটাকে কোলে তুলে নাও,
কত যত্মআত্তি  করে সুস্থ  করে তোলো-
আমি না খেয়ে সটান হয়ে শুয়ে থাকলেও জানো না.
জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেও টের পাও না।

গলির মোড়ের দোকানদার, হকার, ফেরিওয়ালা, কটকটিওয়ালা আসে-
তুমি তাদের চোখের ‍দিকে তাকিয়ে দামাদামি করো-
তারা তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারে অনায়াসে।
আমি পারি না, এক বুক হাহাকার নিয়েও আমার সে সৌভাগ্য হয় না।

বাস কন্ডাকটরও ভাড়া চাইতে এসে ‘ভাংতি পরে নিয়েন’ বলে চলে যায়
তুমি খানিক বাদে বাস কন্ডাক্টরকে ‘মামা ভাংতি হইছে’ জিজ্ঞেস করো।
আমি প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে চুড়ে লুটিয়ে পড়লেও খোঁজ নাও না।

বাড়িওয়ালাও নিয়ম করে মাসে একবার ভাড়া তুলতে এসে তোমার দেখা পায়।
মাঝে মইধ্যে সুবিধা অসুবিধা জানতে আসে তোমার কাছে।
অথচ আমি জানি না কবে তোমার সাথে দেখা হবে কিংবা আদৌ এ জীবনে হবে কিনা!

তোমায় এভাবে প্রতিনিয়ত না পাওয়ার কষ্ট হচ্ছে হোক
আমি এক জীবনে অনেক কিছুই না পাওয়া লোক।


রাজীব নন্দী
২৩-১০-২০১৯, সকাল ১১.৩৫
কামাল প্লাজা, বরিশাল মহাশ্মশান।

উৎসর্গঃ আমার দেবীকে


(আমি এ লেখাটা যখন লিখতেছিলাম দেবী তখন বরিশাল ‍টু খুলনা বাসে বাড়ি যাচ্ছে)

Wednesday, October 16, 2019

মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের ভয়ংকর কঠিন প্রশ্নসমূহ

মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশে এমন কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেছে সে সৌরভ গাঙ্গুলির দাদাগিরির গুগলিকেও হার মানিয়েছে... ভাইরে ভাই! আমি হলে এগুলো পারতাম না।

প্রশ্ন ছিল, টু প্লাস টু কখন ফাইভ হয়?
প্রতিযোগী বলল, যখন এক যোগ করা হয়। হোয়াট এ হলি শিট এন্সার।

পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, ফুটবলকে কেন ফুটবল বলা হয়?

আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, টানতে টানতে মাথার চুল উঠিয়ে ফেলতেছি তবুও কোনো লজিক খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর, একটা অমৃতলালের কারিকর বিড়ির পেছনে আগুন ধরিয়ে বাথরুমে গিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলাম, উহু.. এন্টেনায় কিছুই সাড়া দেয় না। বিড়ি প্রায় শেষ এমন সময়ই মনে পড়ছে, ওহ ফুটবলে তো একটা ফুটা আছে সেজন্যই তো ফুটবলকে ফুটবল বলা হয়।

ওমাইগড, প্রতিযোগী আমার মতো বিড়ি টিড়ি না টেনেই ব্রেইন খাটিয়ে উত্তরটা দিল যে, ফুটবল পা দিয়ে খেলা হয় সেজন্য ফুটবলকে ফুটবল বলা হয়, আমি এটা শুনে চিহ্বায় আর ঠোঁটে এমন কামড় দিলাম যে তিনদিন কোনো ঝোলের তরকারি খেতে পারি নি। ভয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে আড়াই দিন লিপ কিস বন্ধ ছিল। হোয়াট এ হিউমার লেভেল এবং হিউমার টাইপ প্রশ্ন।

পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, বন্দরনগরী বলা হয় কোনটাকে?

আমি ভাবলাম নারায়ণগঞ্জ কিংবা মংলা বন্দর হতে পারে। কিন্তু না, আমাকে ভোদাই প্রমাণ করে দিয়ে এবারের প্রতিযোগীও ঠাস করে বলে দিলেন চিটাগাং। এ তথ্য কখনো বিটিভিতে শুনেছি বলে মনে পড়ে না, জানমুইবা কেমনে। সারাদিন বিটিভি দেখে জ্ঞানের লেভেলের এই শ্রী আমার!

বিচারকও নাছোড়বান্দা, হু হু সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নন। প্রতিযোগিতা করতে আসছো আর সহজেই ইয়েস কার্ড পেয়ে যাবা তা হবে না। সুন্দরী কি বক নাকি যে বাড়ির পাশের ডোবাতে গেলেই পাওয়া যায়, হু। অনেক কঠিন প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তবেই ছাড়া হবে।

বিচারক তাই কাউন্টার প্রশ্ন করলেন, পারলে এবার বল তো, চিটাগাংয়ের বর্তমান নাম কী! হে হে, এবার কোথায় যাবা চান্দু! দিছে আটকাইয়া....

ওমজি ওএমজি....  প্রতিযোগী বুয়েট থেকে পাশ করা বুলেট ছাত্রের মতোই বলে দিলেন বর্তমান নাম- চট্টগ্রাম! কেমনে পারলো এতো কঠিন প্রশ্ন। কেমনে! গুগল করে দেখলাম আসলেই তো চিটাগাংয়ের বর্তমান নাম চট্টগ্রাম। শিট!

দে আর নট অনলি বিউটি বাট অলসো বিউটি উইদ হাই আই কিউ। মারেম্মা!

১৬-১০-২০১৯

Tuesday, September 3, 2019

কিচ্ছু বুঝলাম না

- মানুষের উপকার করলে বিপদ আসে। এক বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড ওর সাথে ঝগড়া করে বসে বসে কাঁদতেছে, তা দেখে আমি চোখের জল মুছে দিতে গেলাম আর অমনি বন্ধু রেগে গেল। কিচ্ছু বুঝলাম না।

- বিয়ে বাড়িতে এক লোকের খেতে খেতে খাবার গলায় আটকে যাওয়া অবস্থা। তো এসব খেতে ওনার কষ্ট হবে ভেবে রোস্টটা আমার প্লেটে তুলে নিলাম। অমনি উনি চোখ বড় বড় করে ইংলিশে কী যেন বলে উঠল।  কিচ্ছু বুঝলাম না।

- ব্যাংকে এক লোক দেখলাম একই টাকা বারবার গুনতেছে। ভাবলাম উনি হয়তো গুনতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলে, গিয়ে গুনে দিই। টাকাটা টেনে আমার হাতে আনতে যাব অমনিই চিৎকার করে উঠলো। কিচ্ছু বুঝলাম না।

- এক মেয়ে অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা পাড় হতে পারছে না। আমি গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে বললাম এবার আমার সাথে আসেন, এই হাতে যাকে একবার ধরে তার আর কোনো ভয় নেই। অমনিই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল। কিচ্ছু বুঝলাম না।

- পাশের ফ্লাটের আন্টি ঝগড়া করে প্রায়ই আংকেলকে বলে, তোমাকে বিয়ে করা আমার জীবনের চরম ভুল হইছে। এটা শুনে একদিন সাহস করে আন্টির পক্ষ নিয়ে বলেই ফেললাম, তাহলে ছেড়ে দেন না কেন এই টাকলু ভুঁড়িওয়ালা মোটকাটাকে। ওমা, এটা বলতেই আন্টি নিজের পায়ের সেন্ডেল খুলে মারলো আমার দিকে। কিচ্ছু বুঝলাম না।

- এক মেয়ে সেদিন, Feeling alone লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল। ভাবলাম, সেও একা আমিও একা তবে গিয়ে ইনবক্সে করি একটু দেখা। তার আগে কমেন্ট করে নজরে আসি। কমেন্ট করলাম, মি টু। সাথে সাথেই ওর বয়ফ্রেন্ড এসে রিপ্লাই দিল, অন্যের গার্লফ্রেন্ডের সাথে ফ্লার্ট না করে নিজের কাজে মন দেন। এ কী কারবার, কিচ্ছু বুঝলাম না।

- তো, আমার সাথে যখন ক্রমাগত এসব ঘটে যাচ্ছে, যখন কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আর কারো ধারে কাছেও যাবো না। নিজের মতো একাকি থাকবো। লোকাল বাসে এক মেয়ে বারবার এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি ভাইয়া বলে যাচ্ছে, আমি ফিরেও তাকাই না। সে হঠাৎ জামার কলার ধরে চিৎকার দিয়ে বলল, ঐ শালারপুত জুতার উপর পারা দিছোস, জুতা ছাড়। আমি চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছি। তখনও কিচ্ছু বুঝলাম না।

~ কিচ্ছু বুঝলাম না
©রাজীব নন্দী
বিচ্ছু || যুগান্তর
৩০-০৬-২০১৯

ছেলে ধরা?

গলির মোড়ে দুই বন্ধু দুষ্টামি করে মারামারি করতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে এক পিচ্চি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাদের মারামারি দেখছে।

রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ সে দৃৃশ্য চোখে পড়লো রিকশা যাত্রীর। তিনি রিকশা থামিয়ে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী দেখো তো। রিকশাওয়ালা আগের জন্মে জ্যোতিষী ছিল তাই ভেবেচিন্তে বলে দিল, স্যার মনে হয় ছেলে ধরা। পাশে দেখেন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর আরেকজন ছেলেধরাকে মারতেছে। লোকটি রিকশা থেকে নেমেই গিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই দুর্বল বন্ধুকে মারা শুরু করলো, একটু পর রিকশাচালকও।

ক্রমে ক্রমে সে মারামারিতে অংশগ্রহণ করল আগত পথচারী....

কোনার মুচি উঠে আসলো হাতে লোহা নিয়ে...

মুদি দোকানি চলে আসলো এক কেজির ওয়েট হাতে....

চা দোকানদার দৌড়ে আসল দুধের পট কাটা ছুড়ি নিয়ে...

সেলুন থেকে ক্ষুর হাতে দৌড়ে আসলো নরসুন্দর...

পথিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসলো আর্তচিৎকার করা রোগী....

জরুরি রক্ত দিতে যাওয়া ডোনার রক্ত গরম করে এসে দুইটা থাপ্পড় মেরে গেল..

পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে টব ছুঁড়ে মারল ইন্টার ফেল ছাত্রী...

জানালা ভেঙে মোটা ভূড়িসহ লাফিয়ে পড়ল অফিসের ঘুষখোর বড় স্যার...

পুলিশের গাড়ি থেকে দৌড়ে ছুটে আসলো খুনের আসামী...

আকাশ পথে যাওয়ার সময় এ দৃশ্য দেখে পাইলট বিমান রেখে ঝাঁপ দিলো জটলার উপর...

লাশবাহী ফ্রিজার থেকে হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠে আসলো লাশটাও.....

তারা কেউ দেখে নি এখানে আসলে কী হয়েছে কিন্তু সবাই দৈববাণীর মাধ্যমে জানে এখানে কল্লাকাটা চক্রের ছেলেধরাকেই মারা হচ্ছে।

©রাজীব নন্দী
২২ জুলাই ২০১৯


প্রতিবেশীর প্রতি বেশি কেয়ারিংয়ের একদিন

সদ্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে জুটেছি। ব্যাচেলর ছেলেমেয়েরা যে এতটা অবহেলিত এটা গ্রামে থেকে কখনো মনে হয়নি। এখানে একদল ঘুষখোর, প্রতারক, জালিয়াতি, চোরাকারবারি বিবাহিতও সহজে বাড়ি ভাড়া পায় কিন্তু নিরীহ শান্ত-শিষ্ট ব্যাচেলররা বাড়ি ভাড়া পায় না। ভাগ্যিস এক বন্ধুর মামা মন্ত্রীকে দিয়ে বাড়িওয়ালাকে ফোন করিয়েছিল নয়তো এ রুমেও পেট উঁচু করে শুয়ে থাকার সুযোগ পেতাম না।

আমি যেখানটায় উঠেছি সে বিল্ডিংটা সাত তলা। আমি থাকি পাঁচ তলায়। পুরো বিল্ডিংয়ে যত মানুষ আছে তা আমাদের পুরো এক গ্রামের সমান হবে। গ্রামের সবার বাড়ির উঠোন থেকে রান্নার উনুন সবই আমার পরিচিত। কিন্তু প্রায় এক বছর থেকেও এখানে তা সম্ভব হয় নি। আমার পাশের রুমের প্রতিবেশী আন্টিকে প্রথম দেখেছি প্রায় আট মাস পর। ভাগ্যিস দেখা হয়েছিল নয়তো প্রতিবেশী হিসেবে মানুষ থাকে নাকি ভূত তা আমি কখনো জানতেও পারতাম না। আর এসব না জানার পেছনে বড় কারণ আমার অন্তর্মুখী স্বভাব। নিজ থেকে যেচে আমি কারো সাথে কথা বলি না। আর সেজন্যই বোধহয় নিচতলা থেকে সাত তলা পর্যন্ত আমার প্রতিবেশী, সুখে দুঃখের সাথীরা অচেনাই রয়ে গেল। কিন্ত এভাবে আর কত দিন! এবার জাগো, মানুষের সাথে মিশতে শিখো। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নাও, তারা খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে সেসব দেখে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসো, প্রতিবেশী কেউ টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে কিনা দেখো। নিজেকেই নিজে বলতে লাগলাম।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে মনস্থির করলাম, আজ প্রতিবেশীদের খোঁজ খবর জানবো। প্রতিবেশী হিসেবে এ দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। সমাজ বইতে কতবার করে এসব পড়েছি ‘প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ তা ভুলে গেলে তো হবে না।

নিচতলায় গিয়ে কলিংবেল দিতেই মধ্যময়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিল। বললাম, আমি এই বিল্ডিংয়েই থাকি, আপনাদের প্রতিবেশী। ভালো আছেন আপনারা সবাই? ফ্যাল ফ্যাল করে এমনভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন, টিভি সিরিয়ালের মেগা এপিসোড চলতেছে। দুই তলায় কলিংবেল দিতেই একটা পিচ্চি দরজা খুলেই বলল, কাকে চান? আমি বললাম, বাবু আমি তোমার প্রতিবেশী। চকোলেট খাবা? চলো তোমাকে চকোলেট কিনে দিবো। ত্যাঁদড় পিচ্চি, ‘মা ছেলেধরা এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে’ বলেই চিৎকার করে উঠল। ওর মা আসার আগেই আমি তিন তলায় চলে এলাম।

দরজায় টোকা দিতেই তা খুলে ধরল একটা ভয়ংকর সুন্দর মেয়ে। কাকে চাচ্ছেন জিজ্ঞেস করতেই বললাল, আপনাকে চাই। আমি পাঁচতলায় থাকি। একই জায়গায় থাকি অথচ আগে কখনো কথাবার্তা হয় নি তাই পরিচিত হতে এলাম, সুখ দুঃখের খবর জানতে এলাম। ওমা, মেয়েটা চোখমুখ লাল করে ধমক দিয়ে বলল, ফাইজলামি করার জায়গা পান না? ব্যাচেলর মেয়ে দেখলেই ফ্ল্যার্ট করতে ইচ্ছে করে? যত্তসব! বলেই ধিরিম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

হচ্ছে কী এসব! এরা কি ছোটবেলায় সমাজ বইতে ‘প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ পড়ে নি। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিতে গেলেও সন্দেহ করে। অথচ গ্রামে আমরা এ মাথা থেকে কুক দিলে ও মাথার লোক চলে এতো। শেষবারের মতো গেলাম সাততলায়। উঁচু তলার মানুষের মনও বোধহয় উঁচু হবে। কলিংবেলের শব্দ শুনেই সবাই মিলে একসাথে দরজা খুলেই বলল, আসুন আসুন। ভেতরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল, বাসা চিনতে সমস্যা হয় নি তো। আমি মুচকি হেসে বললাম, না না সমস্যা হবে কেন! কী অমায়িক ব্যবহার! উঁচু তলার মানুষ সত্যিই উঁচু হয় তা আজ প্রমান পেলাম। একটু পর ভেতর থেকে কাজের বুয়া বের হয়ে বলল, "এইদিকে আহেন, সব ঠিকঠাকই আছিল তয় হঠাৎ কইরা কী যে অইল বুঝতে পারতেয়াছি না।" বলতে বলতে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। আমি এতক্ষণে বুঝলাম তারা আমাকে গ্যাসের চুলা মেরামত করার লোক ভেবেছে। আমি বললাম, "আপনারা যা ভাবছেন আসলে আমি তা নই, আমি পাঁচ তলায় থাকি আপনাদের প্রতিবেশী। পরিচিত হতে এলাম।" এইবার কাজের মহিলা বলে উঠল, "খালাম্মা এইতের ভাব তো ভালা দেহি না। আগে কোনো দিন তো দেহি নাই। কীসের পাঁচতলায় থাকে। কোনো ধান্ধা আছে।" বুঝলাম, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। চিকনে বের হয়ে এলাম।

রুমে ঢুকে ফ্যানের নিচে মাথা দিয়ে বসে আছি। আধা ঘণ্টা পর দরজা টোকার শব্দ শুনি। দরজা খুলে দেখি প্রায় বিশ ত্রিশ জন লোক দাঁড়ানো। তাদের ভেদ করে সামনে আসল, বাড়িওয়ালা। আমি নাকি ছেলেধরা, ইভটিজার এবং চোর। সবাই এমনভাবে তাকাচেছ মনে হচ্ছে যেন আমাকে প্যারাসিটেমলের মতো গিলে খাবে । বাড়িওয়ালা বলল, আমি সিসি ক্যামেরায় সব দেখেছি। একটু পর আসল পুলিশ। আমি যতই বলি আমি প্রতিবেশিদের খোঁজ নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম, অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমার কথা কারোই কানে যাচ্ছে না। প্রতিবেশির প্রতি বেশি কেয়ারিং হতে গিয়ে এত ডেয়ারিং কিছু ঘটে যাবে তা আমার সরল মনের জানা ছিল না। এবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে জীবনে আর কখনো প্রতিবেশীর খবর নিতে যাবো না।

~ প্রতিবেশীর প্রতি বেশি কেয়ারিংয়ের একদিন
© রাজীব নন্দী
বিচ্ছু || যুগান্তর, ২৫-০৮-২০১৯

Tuesday, May 14, 2019

ধর্ষিতার আর্তনাদ

কবর থেকে এক ধর্ষিতার আর্তনাদ।

আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম। সত্যি আমি একদম মরতে চাইনি। আমাকে সমাজ মৃত্যুবরনে বাধ্য করেছিলো। প্রতিনিয়ত ধ্বিক্কার দিতো "এই তুই মর বেশ্যা মেয়ে" বলে।

আর কিছু দিন পরই আমার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে। মা বলেছিলো এবার ভাল রেজাল্ট করলে একটা গিফ্ট দিবে। কতোবার জানতে চেয়েছিলাম মায়ের কাছে কি সেই গিফ্ট, মা বললো আগে বললে মজা থাকবে না। আমি আর কখনোই শুনবো না কি ছিল সেই গিফ্ট, আর কখনোই বলবো না মা আমার ঐ যে মেলা থেকে কিনেছি ঐ নীল ড্রেসটা খুজে পাচ্ছি না মা।

কি ছিল আমার অপরাধ? শুধু মেয়ে হয়েই জন্মেছি এই তো। আমি কি জানতাম এই পৃথিবী আমার বাসযোগ্য নয়? মা তুমি তো জানতা মা এই পৃথিবী হায়েনাদের দখলে তবুও কেন আমাকে জন্ম দিলে মা?

বিশ্বাস করো মা আমি তোমার কথা মতোই কখনো কোন ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকাই নি। ওরা প্রতিদিনই আমাকে বাজে কথা বলতো মা তুমি তো জানো। তোমার কথা মতোই আমি সব নিরবে সয়ে গেছিলাম। আমি কতোবার নিরবে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম তবুও তোমার কথা মনে পরতেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।

আমার তো সেদিন এই পৃথিবীতে আসা উচিত ছিলে যেদিন আমি মুক্ত ভাবে বাঁচতে পারতাম। বড্ড ভুল সময়ে এসে পড়েছি না মা? আমার জন্য তোমাদেরও কতো কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।

ওরা আমায় জোর করে তুলে নিেয় গিয়েছিলো। আমি কতোবার যে ঈশ্বরকে ডেকেছি, তিনিও আমার কথা শুনলেন না, শুনলেন ঐ লম্পট ছেলেদের কথা। আমি তখনি মরে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু শুধু তোমায় শেষ বারের মতো দেখার ইচ্ছে হতেই বেঁচে ছিলাম। আমি জীবিত থেকেও প্রতিটা মুহুর্তে নিজেকে নিজের ঘেন্না হতো, মনে হতো আমি প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মরে যাচ্ছি।

সেদিন যখন পাড়ার লোকজন তোমার দিকে আঙুল তুলে বললো, শুধু তোমার মেয়েকেই কেন ধর্ষণ করলো আরো তো মেেয় আছে নাকি, মেয়ে সমাজের মান সম্মান সব ডুবালো ছেঃ ছেঃ ছেঃ " বিশ্বাস করো আমার কেন যেন মনে হলো আমাকে ঐ লম্পট ধর্ষণ করেছে একবার আর পুরো সমাজ করেছে বারবার।

মা তোমার স্বপ্ন ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবা, দেশের সেবা করবো আমি আর আজ সেই দেশই আমাকে থু থু দিচ্ছে। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে।

এখানে খুব শান্তিতে আছি আমি। মুক্তভাবে কথা বলতে পারি হাসতে পারি লাফাতে পারি। কেউ বলে না এই তুই মেেয় এইসব তোর মানায় না। কোন চিন্তা হয় না যে কালও ঐ বখাটেগুলো রাস্তায় দাড়িয়ে থাকবে বলে। আমি খুব শান্তিতে আছি খুব স্বাধীন আমি এই কবরে।

ভাইটা আমার রোজ আমার কবরের সামনে এসে কাঁদে। আমায় ডাকে। আমি তো কলংকিনী মা, আমি কীভাবে কোন মুখে কথা বলবো ওর সাথে। তুমি ওকে মানা করে দিও কিন্তু। ও নাকি আর কখনো দুষ্টামি করবে না খুব ভদ্র হয়ে যাবে আমি ফিরে আসলে। আমি তো থাকতেই চেয়েছিলাম, সমাজ তো আমাকে রাখতে চায় নি ভাই।

আর বাবাকে বলো শুধু শুধু টাকা খরচ করে মামলা করে লাভ নেই। আমি সব দেখতে পাচ্ছি সব শুনতে পাচ্ছি। ওরা খুব ভালো আছে ওদের কিচ্ছু হবে না মা।

ভালো থাকুক দেশ ভালো থাকো তুমিও মা। অটুট থাকুক সমাজের সম্মান প্রতিটি ধর্ষিতার চাপা কান্নায়।
আমি এবার শান্তিতে ঘুমাই।

Monday, May 13, 2019

প্রতীক্ষার অবসান

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি মানুষ....

তা তো বুঝতেই পারছি। আমি তো বলি নি আপনি দাঁড়কাক কিংবা কোলাব্যাঙ।

কীসব বিচ্ছিরি কথাবার্তা....

কথার প্রারম্ভিকা এমন উল্টাপাল্টা হলে তো এসব শুনতেই হবে। পৃথিবী বদলায়, কতো গৃহবাসী হয় সন্ন্যাসী, কত ভেষজবিদ্যার সফল প্রয়োগ করেও ঝুলে যায় কপোলের আবরিত  আভরণ, তবুও পৃথিবীর কিছু কুনোব্যাঙের কোনো পরিবর্তন নেই। এরা একই সুরে ডেকে যায় আজীবন।

কোলাব্যাঙ থেকে এখন কুনোব্যাঙ হয়ে গেলাম?

তো কী? পুরনো খবরের কাগজের মতো ফেলে রাখা কাউকে এতোবছর পর তোমার মন খুঁজে পেলো কীভাবে? কোথায় লুকিয়ে ছিলে শুনি ?

যে মনের ভেতর ছটফট করে সবসময় তাকে খুঁজে পেতে হয় না।

এতো সাহিত্য বুলিয়ো না। ওসব সাহিত্যই আমার জীবনটা হাহাকারে ভরিয়ে দিয়েছে।  কবিতা গিলিয়ে গিলিয়ে আমাকে আজীবন দাসত্ব গ্রহণ করিয়েছো। আজ মনে হচ্ছে, সবই ভুল ছিল।

এক জীবনে এক বুক হাহাকার না  থাকলে সেটা জীবন নাকি? এতো বছরেও বুঝতে পারলে না তুমি... স্কেল মেপে সঠিকে নয়, ভুলই আমাদের বেঁচে থাকার তৃষ্ণা জোগায়।

তো আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ফোন করেছো তো? দাও সান্ত্বনা.... গলা ভার করে বলো, নশ্বর পৃথিবীতে সবাইকেই চলে  যেতে হবে । কষ্ট পেয়ো না। ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্য করেন।

ঈশ্বর ছাড়া আমাদের শূন্য ঝুলিওয়ালাদের আর কেইবা আছে?

ঈশ্বর! আমাকে ঈশ্বরের কথা বোলো না।  যখন ঈশ্বরকে ডেকে ডেকে গলা শুকিয়েছি, নোনাজলে ডুবিয়েছি  জোড়া-চোখ, বালিশে চাপিয়েছি আর্তনাদ, ঈশ্বর তখন কোথায় ছিলেন? তাঁর জন্যই আমাকে দ্বিচারিণী হতে  হল।

আচ্ছা, সেসব পরে শুনবো। এখন তুমি কেমন আছ?

খুব ভালো। শীতের পাতাঝড়া  গাছের মতো, দমকা হাওয়ায় নিভন্ত প্রদীপের মতো ভালো আছি।

খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে সেদিন আসতে পারি নি। এত বছর পরে তোমার দেখা পাবো, নোনাজলের পর্দা দিয়ে তোমার চোখে তাকানোর সাহস আমার নেই বলে আসা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।

হুম, তুমি তো জ্বলন্ত অগ্নি নয়, পুড়ে যাওয়া ভস্ম দেখতে ভালোবাসো।

সেসব ছাড়ো, তোমাকে ও ভিটায় আর থাকতে হবে না। আমরা অন্য কোথাও চলে যাবো।

স্বামী মরে গেলে সে ভিটা বুঝি আর আমার ভিটা নয়? আর এত বছর পর বিধবার প্রতি দয়া দেখানোর দুঃসাহস তুমি কোথায় পেলে?

দ্বিচারিণী হয়ে সংসার গ্রহণ করে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করতে পেরেছো কখনো? শরীরের আর মনের ভেতর মহাকাশ সমান দূরত্ব নিয়ে তথাকথিত সংসার হয়, ভালোবাসা নয়।

এতোবছর পর তোমার ভালোবাসার কথা মনে পড়লো? নিজেকে একবারও ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে না তোমার?

একজন ভবঘুরে মাতালের চেয়ে ভেবেছি ঐ সংসারী জীবনই তোমার সুখের হবে। তোমায় পাওয়াটাই আমার কাছে মূখ্য ছিল না  শৈলী, তোমার সুখে থাকাটাই ছিল আসল। আমি যতদিনে অন্যকিছু বুঝতে পারি ততদিনে তুমি সামাজিক কারাগারে বন্দি।

আমায় কখনো ডেকেছিলে ফেরার আমন্ত্রণে?

বুকের ভেতর দুঃখের ঝরনাধারা বইয়ে দিয়েও আমি তোমায় সূর্যের মতো হাস্যোজ্জ্বল দেখতে চেয়েছিলাম। আমি বুঝি নি, মৃত্যু উপত্যকায় সূর্যের ঐ হাসি কেবল উপহাস ছাড়া কিছু নয়।

তো ভবঘুরে মাতাল মহাশয় কি এখন মাতাল হয়ে আমাকে ফোন করেছে নাকি হৃদয়ের তীব্র ক্ষতের বেদনা ফোন তুলে দিয়েছে হাতে?

এখন সে ক্ষতে নুন ছিটিয়ে খুব সুখ পাও?

পড়ন্ত বয়সে ক্ষত ছাড়া হৃদয়ে আর কীইবা থাকে। স্মৃতিগুলোকে আজ বিশাল বিশাল দুঃখশালা মনে হয়।

স্মৃতি সবসময়ই হরেক রকম কষ্টের অবতারণা করে, হোক সে সুখের কিংবা দুঃখের। তুমি সেটাও ভুলে গেলে শৈলী?

আমি ভুলে গেলে ফোন রিসিভ করেই তোমার গলাটা কী করে চিনেছি বলো? নারীকে ভোলানো যায়, ভুলানো যায় না।

আজ রাখছি তাহলে। তোমার ঠিক করে রাখা ৯ই ফাল্গুনে দুজন নাহয় বাকি কথা বলবো।

কিন্তু তোমার সংসার? তোমার স্ত্রীকে কী বলবে?

অবিবাহিত পুরুষের স্ত্রী থাকে না। কারো জন্য জমিয়ে রাখা আবেগে আমি অন্য কাউকে ভাগ দিতে পারি নি। এটা আমার ব্যর্থতা হয়তো।

ব্যর্থ মানুষ, মাতাল মানুষ। আমায় পেয়ে তোমার কবিতা লেখায় আবার ভাটা পড়বে না তো?

পড়ুক না হয় ভাটা। যে সাগরে ভাটা নেই সে সাগর জোয়ার থেকে বঞ্চিত থেকে যায় আজীবন।

© রাজীব নন্দী

Thursday, February 21, 2019

একজন স্বপ্নযাত্রী: ইতিহাস, বাস্তবতা ও হাস্যরসের মিশেল

ছোটবেলার ভাদাইম্মা ফরিদ যখন কালের প্রবাহে ল্যাংটা বাবা রূপে তুর্যের সামনে আবির্ভূত হয় তূর্য তখন হতভম্ব হয়ে যায়। তার এই মুখোশহীন ভণ্ডামির কারণ জানতে চাইলে গোপনে বলে, “কী করুম ভাইজান - পুরো দেশটাইতো এহোন ল্যাংটা। একটু চোখ বুইজা ভাবলে অন্তরচক্ষু দিয়া হেই ল্যাংটা লেবাস আমনেও দেখতে পাইবেন। আমাগো দেশের রাজনৈতিক নেতারা তো অনেক আগেই দেশটারে বেশ্যা বানাইয়া রাখছে। যে যার মতো কইরা ভোগ করে।”

এটুকু পড়েই বুঝা যায় লেখকের রাষ্ট্রের প্রতি অনুরাগ। পুরো উপন্যাসেই লেখক নিজের কথাগুলোকে চরিত্রের মুখে বুলি হিসবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান রাষ্ট্রের দিকে তাকালে হয়তো যেকেউই এটা দেখতে পাবে।

তবে এই দায়ভার কি শুধুই রাষ্ট্রের নেতাদের নাকি সাধারণ জনগণের চরিত্রেও সমস্যা আছে? সেটাই বলছেন অন্যখানে । "মানুষ ও পশুর মধ্যে যেমন ভালোবাসা বিনিময় হয় তেমনি চরিত্রেরও বিনিময় হয়। কোনো কোনো সময় মানুষ পশুর চরিত্র ধারণ করে।"

সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেটা হল বেকারত্বের আর্তনাদ। লেখক কখনো সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন বেকারদের আশ্রয়স্থল মেস লাইফের হাসি কান্নার উপাখ্যান যা তার নিজের জীবন থেকেই নেয়া নির্দ্বিধায় বলা যায়। নয়তো এতো সূক্ষ্ণ বর্ণনা কল্পনা থেকে টেনে আসা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।

"আমাদের দেশে আবার মানুষের নাম তার কর্মের উপর ভিত্তি করে বিকৃত হয়ে যায়। অফিসের বড় কর্তাকে আমরা রহিম সাহেব বললেও ঘরের কাজের ছেলের নাম হয় রহিম্মা।" 

বর্ণনায় কখনো কখনো মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন। দাড়োয়ানের স্যালুট দেয়ার বর্ণনায় লিখেছেন, "দাড়োয়ান তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাম পা-টা একটু সামনে টেনে ডানহাত কপালে ঠেকিয়ে, ডানপা উঁচুতে উঠায়ে মুহূর্তেই সে পা ফ্লোরে ফেলে দাড়াম করে শব্দসহকারে স্যালুট করে।"

উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চরিত্রকে আরো বাস্তব করে তোলে। দাড়োয়ানকে উপন্যাসের নায়ক তূর্য যখন তার স্যার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তার উত্তর ছিল, 'আরেহ মিয়া আমাগো মতো লমা-ছমারে কি বড় সাহেবরা অইসব কইয়া যায়।' জন্মসূত্রে ভোলার বাসিন্দা হওয়ায় ভোলার আঞ্চলিক ভাষাটাকেই তিনি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন উপন্যাসে। সেই শব্দভান্ডারের কলসি থেকে ঢাকনা তুলে তা উম্মুক্ত করে দেন সবার জন্য।

উপন্যাসটি এই কারণে আরো গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে একটি পুরাণ ঢাকার একটা বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরেছেন। আশি নব্বইয়ের দশকে যখন এই টাইটানিকসম জাহাজ, জিরাফের মতো মাথা উঁচু করা ভবন এতোটা জনপ্রিয় হয় নি তখন সদরঘাটে ভাসমান হোটেল ছিল। তার উপন্যাসের শুরুতেই সেই ইতিহাস ফুটে ওঠে পাঠকের কাছে। আমার কাছে এই তথ্য আগে সম্পূর্ণ অজানা ছিল।

আগের উপন্যাসগুলো পড়ার সুবাদে বলতে পারি লেখকের ভেতর দেশপ্রেম প্রগাঢ়। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে দেশপ্রেমকে স্থান ছেড়ে দেন।

উপন্যাস থেকে দুটো লাইন কোট করে দিতে চাই পাঠকদের জন্য।
"আসার সময় শাঁখারি বাজার কালি মন্দিরে পুজো দিয়ে আসলেন চান্দুলাল কাকা তূর্যের নামে মানতের। ভালোবাসার কোনো দেশ কাল পাত্র ধর্ম হয় না। ভালোবাসাকে কেবল একটি নিয়ামকেই মাপা যায় আর সেটা হল ভালোবাসা।" এটা আমার কাছে দারুণ লাগছে। চান্দুলাল চরিত্রটাকে এক কথায় বলা যায় মানবতার ফেরিওয়ালা।

আরেকটি কোট  হল-
"পুলিশে দিলে আমিও ওগোরে কইয়া দিমু দোকানে কোন কোন মালের লগে ভেজাল মিশাইয়া মাল বেচেন। তখন বুঝবেন আমি বড় চোর নাকি আপনি!" ফরিদের উক্তি। ফরিদ বাধ্য হয়েই খারাপ পথে হাঁটে। মেসের খরচের জন্য চুরি করে সে। কিন্তু সে চুরি তার কাছে মালিকের চুরির তুলনায় সামান্যই মনে হয়।

পুরো উপন্যাসটাই নায়কের কল্পনার ভেতরে ঘুরপাক খেয়ে যখন শেষ হবে তখন পাঠকের মাথায়ও ঘুরপাক খাবে।
"একদিন একরাতে করেছি প্রেমের সাথে খেলা
একরাত একদিন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা।
একদিন একরাত তারপর প্রেম গেছে চলে
সবাই চলিয়া যায় সকলের যেতে হয় বলে।"

পাঠ শেষে এটুকুই বলবো, লেখক নিজের সাথে নিজেই প্রতিযোগিতা করে দিনদিন উতরে যাচ্ছেন। আরো সময় এবং ধৈর্য নিয়ে লিখলে হয়তো আরো ভালো লেখনী পাবে পাঠক। ঔপন্যাসিকের জন্য শুভ কামনা।

উপন্যাস: একজন স্বপ্নযাাত্রী
লেখক: মাহববু-উল-আলম চৌধুরী
প্রকাশনী : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রকাশকাল : ২০১৯ বইমেলা

রাজীব নন্দী
২১-০২-২০১৯

Sunday, January 6, 2019

গণবিবাহতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান


অনুচ্ছেদ (১-১৪)
........................................
১. এই সংবিধানের মূলমন্ত্র হইবে—আমার বিবাহ আমি করিব, যাহাকে খুশি তাহাকে করিব।

২. পাত্রীর পিতা সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলা হইল—চাহিবামাত্র আপনার বিবাহযোগ্য মেয়েকে বিবাহ দিতে বাধ্য থাকিবেন।

৩. ‘সরকারি পাত্র ব্যতীত আমার কন্যা বিবাহ দিমু না, প্রয়োজনে ঘরের পিলার বানাইয়া রাখমু’—পাত্রীদের প্রতি পিতা সম্প্রদায়ের এরূপ ছেলেমানুষী কথাবার্তা বলা হইতে বিরত থাকিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, বেসরকারি পাত্রদেরও বাচ্চা হইয়া থাকে।
'
৪. একজন বেকার ছেলে বিবাহের কথা বলিলেই মুরব্বিরা সমস্বরে গাহিয়া ওঠেন, ‘বিয়া কইরা খাওয়াবি কী?’ বউ মানেই খাদক প্রাণি—এরকম উদ্ভট ধারণার পরিবর্তন করিবার নিমিত্তে অতি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে।

৫. বেকারদের জন্য ‘গণবিবাহতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ 'ম্যারেজ ব্যাংক' কিংবা 'ব্রাইডাল ব্যাংক' নামে ব্যাংক খুলিয়া সেইখান হইতে লোন লইয়া বিবাহ করিবার পথ সুগম করিবার পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।

৬. সভ্যতা টিকাইয়া রাখিবার মূল হাতিয়ার হইল জনগণ। তাই এই সংবিধান অনুযায়ী অন্যান্য মৌলিক চাহিদার মতো বিবাহকেও মৌলিক চাহিদা হিসেবে ঘোষণা করা হইলো।

৭.  অনেক পুরুষ একটিমাত্র বিবাহ সম্পন্ন করিয়া দমিয়া যায়, ফুলদানিতে ভিজাইয়া রাখা ফুলের মতো নিস্তেজ হইয়া পড়ে। অতি শীঘ্রই এর সঠিক কারণ জানিয়া তাহা সংস্কার করিবার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।

৮. বিবাহের নামে মেকআপ বিজনেস, ফটোশ্যুট বিজনেস, সেলফি ডিজিজের মাত্রা দিনদিন বাড়িয়াই চলিতেছে। সময় থাকিতে এইসবের লাগাম টানিয়া ধরিতে হইবে।

৯. যৌতুকের নাম করিয়া দিনে-দুপুরে কোট-প্যান্ট পরিধান করিয়া সকলের চর্মচক্ষুর সম্মুখে ভদ্রবেশে ডাকাতি বন্ধ করিতে হইবে।

১০. বিবাহের রাতে মেয়েপক্ষের ঘাড়ে হাজার হাজার অতিথি সেবন করাইবার প্রথার নামে লুটপাট বন্ধে সুশীল সমাজের মুখের ঠুসি খুলিয়া এর বিরুদ্ধে কথা বলিতে হইবে।

১১. বিবাহের পর হনলুলু, পাতায়া কিংবা যেকোনো জায়গায় হানিমুন করিবার সম্পূর্ণ খরচ 'গণবিবাহতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার'কে বহন করিবে। তবে বাচ্চার দায়ভার পাত্র-পাত্রীই নিজেদেরই বহন করিবে।

১২. যেইদিন বাচ্চার ওয়া ওয়া ক্রন্দন ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হইয়া উঠিবে, সেইদিন হইতে ওই দম্পতির 'গণবিবাহতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান' অনুসারে ‘নব-দম্পতি’ তকমা বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।

১৩. বিবাহই জীবনের সব। জীবনে প্রচুর বিবাহ করিতে হইবে। তাই বিবাহ-পাগলা সমাজের জন্য এই স্বতন্ত্র ‘গণবিবাহতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান’ ঘোষণা করা হইল।

১৪. পরিশেষে মনে রাখিতে হইবে, বিয়ে যতই হউক না কেন, সন্তান যেন একটির বেশি না হয়। কারণ বিবাহের দায়িত্ব গণবিবাহতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব যার যার।

©রাজীব নন্দী
প্রকাশিত: ঠাট্টা | ইত্তেফাক
৬-০১-২০১৯ সংবিধান