Sunday, November 27, 2016

সমকাল ট্যাবলয়েড ‘প্যাঁচআল’য়ে লেখালেখি



    দৈনিক সমকালের সোমবারের ট্যাবলয়েড ‘প্যাঁচআল’এর পাতায় আমার লেখালেখি-রাজীব নন্দী


ইত্তেফাক ট্যাবলয়েড ‘ঠাট্টা’য় লেখালেখি

      দৈনিক ইত্তেফাকের রবিবারের ট্যাবলয়েড ‘ঠাট্টা’ এর পাতায় আমার লেখালেখি - রাজীব নন্দী

Saturday, November 26, 2016

পরী -১

পরী,
....জানি একদিন তুমি বুড়ি হবে। তোমার যে মোহনীয়তা আমার মাদকতার মাত্রা ছাড়িয়ে দিত তা প্রকৃতি গ্রাস করে নেবে। তোমার থুতনীতে ভাঁজে ভাঁজে হয়ত কত আফসোস ভেসে উঠবে। তোমার হাসির ঝরনাধারা শুকিয়ে যাবে, যে চোখে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম বেঘোরে সেখানে হয়তো মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে পিটপিট করে দেখতে চাইবে। যে হাতে নিজের ভালোবাসা মিশ্রিত আঙ্গুল গুঁজে দিতে চেয়েছিলাম সেখানে আঁকড়ে ধরবে নির্জীব লাঠি।
.
তোমার স্বামীকে আমি আমার একজনমের শত্রুর খাতায় নাম লেখাব। কি সৌভাগ্য পুরুষটার। যেই তোমাকে আমি ভালোবাসার চাঁদরে আগলে রাখতে চেয়েছি, যেই তোমাকে আমি আমার এক বিছানার সঙ্গী হিসেবে চেয়েছি, যেই তোমাকে নিয়ে ভেবে ভেবে মাথার চুল ছিঁড়েছি চারআনা, সেই তোমাকে এসে টুপ করে হাত ধরে বসবে।
.
ভাবছো তোমায় কেন 'ভালোবাসি' বলি না? কত ছেলে উম্মাদ হয়ে তোমায় এই শব্দ বলেছে সে পরিসংখ্যান সহজেই অনুমেয় আমার। আমি তো সে কাতারে নাম লিখাতে চাই নি। আমি চেয়েছি রবীন্দ্র উপন্যাসের মত তুমি আমায় পড়ে পড়ে গভীরে যেতে চাইবে, শরৎ উপন্যাসের মত আগ্রহ ধরে রাখবে আমার প্রতি কিন্তু না তুমি হেলাল হাফিজের কষ্টকেই বেছে নিলে আমার জন্য। তোমার পছন্দ আছে ঢের। সেটা কি করে উপেক্ষা করি বলো!
.
হয়ত সুখে থাকবে হঠাৎ করে চিনে ফেলা পুরুষটার পৃথিবীতে। দমকা হাওয়ার পিদিমের মত আমার নতুন ভাবনারাও নিভে যেতে যেতে হয়ত বেঁচে থাকবে। আবার নতুন করে সেই সলতেয় আগুন জ্বলবে, চারদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আমার পৃথিবীর। কেবল পিদিমের নিচে যে অন্ধকারটা রয়ে যাবে সেটাকে চাইলেও সরাতে পারবো না, কিছুতেই না।
.
আমি
অব্যক্ত প্রেমিক।


(পরীকে লেখা প্রেম পত্র-১)

Wednesday, November 23, 2016

সিনেমাটোগ্রাফি, নাটকের স্ক্রিপ্ট যেভাবে লিখবেন

কিভাবে আপনার প্রথম চলচ্চিত্রটি বানাবেন ? (টিউটোরিয়াল )
পর্ব - ০১
কৈফিয়ত
আপনার মধ্যে স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন একটি চলচ্চিত্র বানানোর। স্বপ্ন একজন চলচ্চিত্রকার হওয়ার। কিন্তু জানেন না কিভাবে বানাতে হয় একটি চলচ্চিত্র। আপনার জন্য এই বই।
চলচ্চিত্র বানানোর স্বপ্ন দেখেন বলেই ধরে নেয়া যায় আপনি সৃজনশীল। আপনি একটি জানা ঘটনাকে গুছিয়ে লিখতে পারেন। আপনি একটি ঘটনাকে কল্পনার রং চড়িয়ে আরও আকর্ষণীয় করতে পারেন। কিন্তু সেগুলো কেবল কাগজ ও কলমে। সেই গল্পটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়ার জন্য আপনার জানা চাই কিছু কলা-কৌশল। সেই কলা-কৌশলগুলিই এই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।
আপনি শিখবেন কিভাবে সৃজনশীল চিন্তা করতে হয়, কিভাবে চিন্তাকে গল্পে রূপান্তর করতে হয়, কিভাবে গল্পকে চলচ্চিত্র মাধ্যমের উপযোগী করতে হয়। আরও শিখবেন, কিভাবে গল্পকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ছবি ও শব্দে বেঁধে ফেলবেন। ক্যামেরার ভাষায় আপনার গল্পটিকে কিভাবে জীবন্ত করে তুলবেন এবং ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবিগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করবেন। জানবেন, চলচ্চিত্র বানাতে হলে কাদের সহায়তা আপনাকে নিতে হবে, কাদের সঙ্গে আপনি মিলে মিশে কাজ করবেন এবং তাদের কাছ থেকে কিভাবে কাজ বের করে আনবেন।
কেবল স্বপ্ন আর এই বইটি পুঁজি করে আপনি বানিয়ে ফেলতে পারবেন আপনার প্রথম চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রকার হওয়ার পথের প্রথম পদক্ষেপ নিচ্ছেন আপনি। স্বপ্নিল এ পথের যাত্রা শুভ হোক।
আপনার প্রথম পদক্ষেপ : চাই একটি গল্প
চলচ্চিত্র বানাবেন কেন ? কারণ আপনি একটি গল্পকে দর্শককে দেখাতে ও শোনাতে চান। চলচ্চিত্রের ভাষায় গল্পের ছলে আপনার নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারণা দর্শককে জানাতে চান। দর্শককে বিনোদন দিতে চান।
কিভাবে বানাবেন আপনার গল্পটি ? গল্পটির একটি শুরু থাকবে, মধ্য থাকবে এবং শেষ থাকবে। আর গল্পটির মধ্যে থাকবে একটি দ্বন্দ্ব। কোন একজন ব্যক্তির গল্প হবে এটি। সে কিছু অর্জন করতে চায়। সেই চাওয়াটা বিশাল কোন চাওয়া থেকে সামান্য কিছু হতে পারে। সে চায় মন থেকে। সে পিছ পা হওয়া জানে না। সে একটা পণ করেছে। কিন্তু তার সেই অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। কেননা, তার এই অর্জনের পথে রয়েছে এক বা একাধিক বাধা। সেই বাধার মধ্যে কিছু তার নিজের মধ্যে বা অন্য কোন ব্যক্তি তার পথের কাঁটা। সুতরাং একটি সংঘাত অনিবার্য। চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই প্রতি পদে পদে সংঘাত হবে। সেই সংঘাতে ব্যক্তিটি বিজয় লাভ করবে বা হেরে যাবে।
সহজ কথায় পৃথিবীর তাবৎ সিনেমার গল্প এটি। এর বাইরেও সিনেমা হয়। নানা রকম সিনেমা হয়। এত রকম হয় যে, এক কথায় সেটা বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু আমরা এত জটিলতায় যাব না। কেননা, আমরা মাত্র শেখা শুরু করেছি। আমরা সহজ করে শিখব। যত সহজ করে সম্ভব তত সহজ করেই আয়ত্ত করব চলচ্চিত্র বিদ্যা। এই বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্যই পণ করেছি জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র বানাব ।
আসুন, কাজে নেমে পড়া যাক।
পর্ব - ০২
প্রথম কাজ : সৃজনশীল ভাবনা গল্পের তরে
ভাবনা হবে সৃজনশীল। মানে সৃজন করার জন্য। সৃজন করতে হলে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা এলোমেলো হলে হবে না। হতে হবে গুছানো। হতে হবে পরিকল্পিত। হবে হবে সেই মাধ্যমের উপযোগী যেই মাধ্যমে সৃজনশীল কাজটি হবে।
আপনি চলচ্চিত্র বানাবেন। তার জন্য গল্প লিখবেন। সেই গল্প হতে হবে চলচ্চিত্রের উপযোগী। নচেৎ সেই গল্পের কোন মূল্য নাই।
চলচ্চিত্রের গল্প কেমন হয় ? চলচ্চিত্রে আমরা কতগুলো চলমান দৃশ্য দেখি। আর শুনি কিছু শব্দ। তাই গল্পের মধ্যে থাকতে হবে কিছু দৃশ্য বা ছবি এবং কিছু শব্দ। যেই গল্পই বানান না কেন সেটাকে দৃশ্যে এবং শব্দে প্রকাশ হবে।
কিভাবে বানাবেন চলচ্চিত্রের গল্প ?
পৃথিবীর সব গল্প বানানোর একটা সহজ নিয়ম আছে।
এই সহজ নিয়মের জন্য দরকার মগজের ঝড়। ইংরেজিতে যেটাকে বলে ব্রেইন স্টর্মিং - সেটার সোজা বাংলা মগজের ঝড় বলাই ভালো।
যাই হোক, মগজের ঝড় কিভাবে তুলবেন এবং সেটাকে কিভাবে আপনার গল্প বানাতে ব্যবহার করবেন সেটাই হল আলোচ্য বিষয়। এই মগজের ঝড় তোলার নানা কায়দা আছে। অত বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমরা সহজ করে বুঝি।
প্রথমে ভাবুন একটা মূল বক্তব্য নিয়ে। কী বলতে চান আপনি এই চলচ্চিত্রের দিয়ে ? যেমন, আপনি বলতে পারেন :
০১) মানুষ মানুষের জন্য।
এই সহজ কথাটি বোঝানোর জন্য আপনি একটি গল্প তৈরি করতে পারেন । সেই গল্পে কোন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে অন্য মানুষের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবে। অপর জন তার এই বিলিয়ে দেয়ার কথা প্রথমে জানবে না। যখন জানবে তখন আর প্রতিদান দেয়ার সময় নাই।
অথবা
০২) প্রেম নয়, টাকাই বড়।
একটি প্রেমের গল্প। গল্পের শেষে দেখা গেল কেবল টাকার জন্য নায়ক / নায়িকা অপর জনকে ছেড়ে গেল। অপরজন তার এই দুঃখে তার জীবন বিসর্জন দিল ।
অথবা
০৩) টাকা নয়, প্রেমই বড়।
এইটিও একটি প্রেমের গল্প। এই গল্পে গল্পের নায়ক টাকার মোহ ছেড়ে তার প্রেমাস্পদকেই বড় করে দেখবে। টাকা বা সম্পদের হাতছানি এড়িয়ে সে তার প্রেমের জন্য একের পর এক ত্যাগ করতে লাগল। কিন্তু তার এই প্রেমের মূল্য দিতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হল।
আরেকটা কথা, গল্পের এই মূল বক্তব্যটা গোপন রাখতে হবে। কোথাও প্রকাশ্যে বলা যাবে না। যত গোপন রাখা যাবে, যত কৌশলী হওয়া যাবে, ততই গল্পটা শৈল্পিক হয়ে উঠবে । কিন্তু সে জন্য গল্পটি জটিল করা যাবে না, গল্পটি হবে সহজবোধ্য, যুক্তিসঙ্গত, অদ্বিতীয় ও স্বাভাবিক সম্ভাব্য ঘটনায় ভরপুর। এমন কোন ঘটনা থাকবে না, যেটা খাপ খায় না, অস্বাভাবিক লাগে। তেমন কোন ঘটনা জুড়ে দেয়ার লোভ দমন করতে হবে, আবেগ সংযত করে সেই অংশটুকু নিষ্ঠুরের মতো বাদ দিয়ে দিতে হবে।
এবার মগজের ঝড় বিষয়টা বোঝার জন্য একটা অনুশীলনী করা যাক।
অনুশীলনী :
০১) এক টুকরো সাদা কাগজ ও কলম নিন।
০২) একটি শব্দে একটি বিষয় বেছে নিন। শব্দটি কাগজের মাঝখানে লিখুন। মনে করুন, এটি একটি বীজ। এই বীজ থেকে একটি চারা গাছ জন্মাবে। এই চারাগাছটিই আমাদের নির্মিয়মান চলচ্চিত্রটি। যেমন : শব্দ হল - ঈর্ষা।
০৩) এবার সেই শব্দটি থেকে একটি বাক্য রচনা করার চেষ্টা করুন। বাক্যটি চারাগাছটি কত বড় হবে সেটা নির্ধারণ করে দেবে। যেমন : ঈর্ষা মানুষের সর্বনাশ করে।
০৪) এই বাক্যটি এমন হবে যেন গল্পের শুরু, মধ্য ও শেষ বিষয়ে একটা আভাস দেয়। যেমন : ঈর্ষা মানুষের সর্বনাশ করে - এই বাক্যে একটা গল্প শুরু হবে ঈর্ষা দিয়ে এবং মধ্যভাবে ঈর্ষার মাধ্যমে কেউ কারো ক্ষতি করবে এবং গল্পের শেষে তার হবে সর্বনাশ। তার মানে হল এই বাক্যটি এমন যে, এই বাক্যটি থেকে এমন একটি গল্প তৈরি করা সম্ভব - যার শুরু, মধ্য ও শেষ আছে।
০৫) এই বাক্যের চারপাশে সাদা কাগজের মধ্যে ঈর্ষা ও সর্বনাশ সংক্রান্ত যত শব্দ মনে পড়ে সবগুলো শব্দ লিখে ফেলুন। প্রত্যেকটি শব্দ দিয়ে একটি করে ঘটনা তৈরি করার চেষ্টা করুন। কিন্তু এই ঘটনাগুলো মূল বাক্যের বিপরীত কোন বক্তব্য প্রকাশ করবে না।
যেমন : লিখুন, ক্ষতি করা, চুরি করা, আগুন লাগানো, এসিড মারা, কান ভাঙ্গানি দেয়া - এই প্রতিটি কাজ ঈর্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ।
আবার সর্বনাশের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দ হতে পারে - মারামারি হওয়া, সংঘর্ষ হওয়া, দাঙ্গা লাগা, টাকা হারানো, মামলা -মোকদ্দমায় জড়ানো, লুট হওয়া, ভাংচুর হওয়া, অসুস্থ হওয়া ইত্যাদি।
০৬) এই ভাবে শব্দ লিখে লিখে কাগজটি ভরে ফেলুন। যত বেশি শব্দ লেখা যায়, ততই ভালো। তবে শব্দগুলির মধ্যে দেখার ও শোনার উপাদান থাকলে ভালো হয়। কেননা চলচ্চিত্র তো দেখা ও শোনার মাধ্যম। কিন্তু এমন কোন শব্দ লেখবেন না যেটা এই মূল বক্তব্য বা বাক্যটির সাথে সম্পর্কিত নয়।
০৭) বীজ থেকে পুরো বৃক্ষ হতে যেমন নানা দুর্যোগ পেরুতে হয়, তেমনি অনেক বাধা বিঘ্ন ঘটার মতো ঘটনার কথা লিখুন। তবে সেই সব ঘটনা এই কাগজে নয়, অন্য কোন কাগজে লিপিবদ্ধ করুন।
০৮) তার মানে দাঁড়াল এই, আপনি মূল বক্তব্যটি দিয়ে এমন একটি বাক্য রচনা করবেন যেটা গল্পের শেষ, মধ্য ও শুরু প্রকাশ করবে। বিশেষ করে গল্পের শেষটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গল্পের শেষ কিভাবে হবে সেটাই আগে নির্ধারণ করে নিন।
এই যে কাজটা করলাম, এটাই হল মগজের ঝড় বা ব্রেইন স্টর্মিং। একটা ভালো গল্প লেখার জন্য মগজে ঝড় তুলে বিষয়টা আগে বুঝে নিতে হবে। এটা হল সহজ পন্থায় মগজের ঝড়। নানাভাবে মগজের ঝড় তোলা যায়। এই কাজটি নতুনদের জন্য খুবই জরুরী। যারা অভিজ্ঞ তাদের জন্য এই রকম মগজের ঝড় না তুললেও চলবে।
পর্ব - ০৩
সৃজনশীলতার যাদুর সঙ্গে এবার মেশাই জ্ঞানের নেশা :
সৃজনশীলতার যাদুর জগৎ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেয়া গেছে। মগজের ঝড় তুলে আপনি সৃজনশীলতার জগৎ সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিয়েছেন। এবার আসুন এই যাদুর সঙ্গে মেশাই জ্ঞানের নেশা। কেননা চলচ্চিত্র এই যাদু ও নেশার জগৎ।
কাগজে কলমে সিনেমার যে গল্পটি লেখা হয় সেটাকে বলে চিত্রনাট্য। আগে চিত্র পরে নাট্য। এতে চিত্রও আছে, নাট্য আছে। তাহলে চিত্র ও নাট্য উভয় সম্পর্কে জানতে হবে।
চিত্রনাট্য লিখতে হলে যা যা জানতে হবে --
বিষয়বস্তু :
যে বিষয়বস্তু নিয়ে আপনি সিনেমা বানাবেন তার সম্পর্কে জানতে হবে। একজন সাংবাদিক যেভাবে একটা সংবাদ লেখার আগে ঘটনা সম্পর্কে জেনে নেয়, তেমন করে জেনে নিতে হবে। অথবা একজন গোয়েন্দা যে রকম গোপনে একটা বিষয় সম্পর্কে জেনে নেয়, সেভাবে বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে হবে। তারপর ওই বিষয়ে সম্ভাব্য সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বইপত্র, পত্রিকা, সিনেমা, নাটক এবং ইন্টারনেট হতে পারে উৎস। মোট কথা বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান না থাকলে ভালো সিনেমার গল্প লেখা যায় না।
বিষয় বেছে নেয়ার সহজ কৌশল হল, নিজের বা পরিচিত জনের জীবন কাহিনী বেছে নেয়া। তার সঙ্গে নিজের কল্পনা ও সৃজনীশক্তি মিলিয়ে বানানো যায় চমৎকার গল্প।
অনুশীলনী :
০১) একটি ছোট নোট বুক ও কলম নিন।
০২) যে বিষয়ে লিখতে চান সে বিষয় সম্পর্কে কয়েক জনের সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় যে ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইবেন, সেই ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা, ধর্ম, জাতীয়তা, তার সঙ্গে পরিবার, সহকর্মী, সহপাঠী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক খুজে বের করুন।
০৩) একই বিষয় নিয়ে রচিত উপন্যাস পড়ুন। পত্রিকায় এর সম্পর্কিত কোন খবর থাকলে পড়ুন। অন্যান্য বই পড়ুন। ম্যাগাজিন পড়ুন। ইন্টারনেট ঘাটুন। নাটক ও সিনেমা দেখুন।
মূলবক্তব্য বা প্রেমিজ :
মগজের ঝড় তুলতে গিয়ে আমরা মূলবক্তব্য নিয়ে কাজ করেছি। ফলে আমরা ইতিমধ্যে জানি প্রত্যেকটি গল্পেরই একটি মূল বক্তব্য থাকে। একই বিষয়ে গল্প লেখা হলেও মূলবক্তব্য ভিন্ন হয়।
যেমন : ০১) প্রেম একটি স্বর্গীয় বিষয়।
০২) প্রেম কেবল কাঁদায়।
এই দুটি মূল-বক্তব্যের বিষয় একই কিন্তু বক্তব্য ভিন্ন।
মগজের ঝড় তোলার কৌশল কাজে লাগিয়ে মূল বক্তব্য নির্ধারণ করা যায়।
প্লট বা বৃত্ত :
প্লট বা বৃত্ত হল কাহিনী। যে বিষয়ে সিনেমা বা নাটক বানাতে চান, সেই কাহিনীকে তত্ত্বীয় ভাষায় বলা হয় প্লট বা বৃত্ত। কাহিনীর মধ্যে ২ ধরনের কাহিনী থাকে। একটি হল মূল কাহিনী বা মেইন প্লট। যেই লোকটি কাহিনীর প্রধান চরিত্র, তার কাহিনীটিই হল মেইন প্লট বা প্রধান বৃত্ত। এর বাইরে অন্য কোন চরিত্রের কাহিনী যুক্ত থাকলে সেটাকে বলা হয় সাব-প্লট বা অপ্রধান বৃত্ত। সাব-প্লট বা অপ্রধান বৃত্ত মূলত মেইন প্লট বা প্রধান বৃত্তের কাহিনীকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
সিনেমার প্লট বা বৃত্ত তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচ্য :
০১) গল্পটি কি দরকার আছে ?
০২) এ গল্পটি কী বোঝায় ? উদ্দেশ্য কী ?
০৩) এ সিনেমাটি কি নতুন কোন কিছু বলে ?
অনুশীলনী :
০১) একটি এ-ফোর সাইজের কাগজ নেন।
০২) পুরো গল্পটি এক পাতায় লিখুন।
০৩) এ ক্ষেত্রে কোন অতিরিক্ত চিন্তা ভাবনা করবেন না। কেবল ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লিখে যান।
দ্বন্দ্ব /সংঘাত :
সিনেমা বা নাটকের গল্পে ২টি প থাকে। সেটা হতে পারে নায়ক বনাম প্রতি-নায়ক, নায়ক বনাম প্রকৃতি, নায়ক বনাম রাষ্ট্র ইত্যাদি। আরেকটি দ্বন্দ্ব হল নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্ব - যাকে বলা হয় আত্ম -দ্বন্দ্ব। একই সাথে গল্পের মধ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে আত্ম-দ্বন্দ্ব ও বহির্মুখী দ্বন্দ্ব। ফলে গল্প হয়ে উঠবে আরও নাটকীয়।
দর্শক হিসেবে মানুষ সব সময় লড়াই বা প্রতিযোগিতা দেখতে পছন্দ করে। এ জন্যই প্রতিটি খেলাতেই ২টি পক্ষ থাকে। এক পক্ষ জেতে ও অপর পক্ষ হারে। এই হারজিত সিনেমার কাহিনীতেও থাকে। সাধারণ নায়ক জেতে ও প্রতি-নায়ক হারে। আবার কখন নায়ক হেরে যায়। কোনটা হবে সেটা নির্ধারণ করবেন আপনি।
অনুশীলনী :
০১) আপনার পরিচিত একজন মানুষকে বেছে নিন।
০২) খুঁজে বের করুন তার সঙ্গে কার সংঘাত আছে।
০৩) কেন সংঘাত ? কোন বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ?
০৪) আপনি কার প নেবেন ? কেন ?
০৫) আপনার চোখে এই দ্বন্দ্বে কে নায়ক ও কে প্রতি-নায়ক ?
সাসপেন্স /টেনশন / উৎকণ্ঠা :
তারপর কী হবে - এই সাধারণ চিন্তাটা আসে উৎকণ্ঠা থেকে। উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করতে হয় গল্পের মধ্যে। কেননা, উৎকণ্ঠা দর্শককে পরবর্তী উৎকণ্ঠা দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে। উৎকণ্ঠা ছাড়া সিনেমা হবে ম্যাড়মেড়ে।
একশনে তৈরি হয় উৎকণ্ঠা। চোর পালাচ্ছে, তার পিছু নিয়েছে পুলিশ। দর্শকের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হবে। চোরকে কি ধরতে পারবে পুলিশ ? সিনেমায় উৎকণ্ঠা সৃষ্টির জন্য দুটি দৃশ্যকে পাশাপাশি দেখানো হয়। যেমন : নায়িকা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওদিকে নায়কের ভুল ভেঙ্গেছে। সে তাকে আনতে গেছে তার বাড়ি। বাড়ি থেকে স্টেশনের দিকে রওয়ানা হয়েছে। নায়িকা টিকেট কাটছে। নায়ক গাড়িতে ছুটছে। নায়িকা ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে ট্রেনের দিকে। নায়কের গাড়ি ট্রাফিক জ্যামে।
এই রকম পাশাপাশি দুটি স্থানের দৃশ্য দেখিয়ে সিনেমায় দর্শক মনে চরম উৎকণ্ঠা তৈরি করা যায়।
সংলাপে তৈরি হয় উৎকণ্ঠা।
যেমন : নায়ক : আমি যাব।
নায়িকা : আমি যাব না।
ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল উৎকণ্ঠা। তারা কি আদৌ যেতে পারবে ?
এইভাবে একশন বা নাট্যক্রিয়া এবং সংলাপে উৎকণ্ঠা তৈরি করতে হবে।
অনুশীলনী :
০১) একটি গল্পের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা লিখতে শুরু করুন। ঘটনাগুলোর নাম্বার দিন।
০২) প্রতিটি ঘটনা লিখুন একটি বাক্যে।
০৩) এমনভাবে লিখুন যেন তারপর কী হবে সেটা জানতে কৌতুহল তৈরি হয়।
০৪) যতক্ষণ পর্যন্ত এই কৌতুহল বা উৎকণ্ঠা তৈরি না হবে ঘটনাগুলো সাজাতে থাকুন, নতুন ঘটনা যোগ করুন, পুরোনো ঘটনা বদলে ফেলুন।
চরিত্র :
কোন একজন মানুষের জীবনে কাহিনী নিয়ে হয় নাটক বা সিনেমা। যেই মানুষটির কাহিনী নিয়ে নাটক বা সিনেমা হয় সেই মানুষটি হল চরিত্র।
একটি মানুষের চরিত্র বুঝতে হলে তার ৩টি দিক বুঝতে হয়। তার ব্যক্তিগত দিক, পারিবারিক দিক ও সামাজিক দিক। চরিত্রের নাম, বয়স, পিতা-মাতা, বন্ধু বান্ধব সবাইকে দেখে চরিত্রটি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
সিনেমার চরিত্র তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচ্য :
০১) চেহারা, ০২) পোশাক, ০৩) বয়স, ০৪) কার্যকলাপ ০৫) সংলাপ, ০৬) অন্য লোক তার সম্পর্কে যা বলে। ০৭) সে নিজের সম্পর্কে যা বলে। ০৮) রক্ত মাংসের মানুষ হতে হবে। ছাচে ঢালা চরিত্র বাদ দিতে হবে। ০৯) চিত্রনাট্যকারকে চরিত্রের ভেতর থেকে কথা বলতে হবে। ১০) চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে এমন কোন আচরণ থাকতে পারে - যা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত না হলেও চরিত্র চিত্রণের জন্য ব্যবহৃত হবে। ১১) চরিত্রের মধ্যে একটা ক্ষুধা থাকবে। একটা বিশেষ বাতিক থাকতে পারে।
অনুশীলনী :
০১) একটি পরিচিত মানুষকে বেছে নিন।
০২) নিন্মের ছক অনুসারে তার সম্পর্কে সব তথ্য লিখে ফেলুন। এটাকে বলা হয় ত্রৈমাত্রিক চরিত্রের অস্থি সংস্থান। এটি তৈরি করেছেন লাজোস এগরি।
চরিত্রের নাম :
(ক) শরীরতাত্ত্বিক মান
১. লিঙ্গ : , ২. বয়স : , ৩. উচ্চতা : , ৪. ওজন : , ৫. চুলের বর্ণ : , ৬. চুর বর্ণ : , ৭. চর্মের বর্ণ : , ৮. আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য : ৯. আকৃতি : [ দৃষ্টিনন্দন : অতি ও কম ওজন : পরিচ্ছন্ন : পরিপাটি : খোসমেজাজী : মস্তিষ্ক-মুখ- বাহুর আকৃতি : অসমতা : ] , ১০. বিকৃতি : , ১১. বংশানুবৃত্তি :
(খ) সমাজতাত্ত্বিক মান
১. শ্রেণী : [ শাসকশ্রেণী : মধ্যবিত্ত : পাঁতিবুর্জোয়া : শ্রমজীবি : ], ২. বৃত্তি : [ কাজের প্রকৃতি : কাজের সময় : মাত্রা : আয় : কাজের শর্তাবলী : প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বা বাইরে : প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক : কাজের যোগ্যতা : ]
৩. শিক্ষাদীক্ষা : [ শিক্ষার পরিমাণ : শিক্ষালয়ের মান: পরীক্ষার ফল : প্রিয় বিষয় : কোন কোন বিষয় সবচেয়ে কম জানে : দতা : ]
৪. পারিবারিক জীবন : [ পিতা মাতা কি জীবিত নাকি মৃত ? তাদের উপার্জন মতা : পিতা : মাতা : পিতামাতার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছে কি না : বিচ্ছেদের কারণ : পিতামাতার মানসিক উন্নতির মান : তাদের দোষ : পিতা : মাতা : আসক্তি : পিতা :
মাতা : বিরাগ বা উপো : পিতা : মাতা : চরিত্রের সংগ্রামশীলতা : পিতা : মাতা : ] , ৫. ধর্ম : , ৬.জাতি : ৭. সামাজিক প্রতিষ্ঠা : (বন্ধুবান্ধবমহলে, সভা-সমিতি-খেলাধূলায় নেতা কি না) : ৮. রাজনৈতিক মতবাদ : ৯.আমোদ প্রমোদ, বাতিক : (বই, খবরের কাগজ, মাসিক পত্রাদি পড়ার ঝোঁক) :
(গ) মনস্তাত্ত্বিক মান
১. যৌনজীবন : , ২. নৈতিক মান : , ৩. ব্যক্তিগত প্রকৃতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা : , ৪. আশা ভঙ্গ, প্রধান অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা : ৫. মেজাজ : [ কড়া মেজাজী : নরম মেজাজী : নৈরাশ্যবাদী : আশাবাদী : ] ,৬. জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি : [ সমর্পিত : সংগ্রামী : পরাজিতন্মন্য : ]
৭. মনোগ্রন্থি : [ মনোবোধ আচ্ছন্ন : অভ্যাসগত কাজের বিরতি : কুসংস্কার : বাতিক : আতংক : ] ৮. লোক ব্যবহার : [ বহির্মুখী : অন্তর্মুখী : উভয়মুখী :
৯. দক্ষতা : [ ভাষাজ্ঞান : বিশেষ কর্মদক্ষতা : ]
১০. গুণ : [ কল্পনাশক্তি : বিচারশক্তি : সুরুচিবোধ: ভারসাম্য : ]
১১. বুদ্ধির মানাঙ্ক :
০৩) সবগুলো তথ্য একবার মনোযোগ দিয়ে পড়ুন । আশা করি, তার চরিত্রটি সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন।
একশন বা নাট্যক্রিয়া :
নাট্যক্রিয়া বা একশন সিনেমার গতি তৈরি করে। আমরা প্রতিদিন কত শত কাজ করি। সে গুলোর সবই ক্রিয়া বা একশন। এই একশন দেখা যায় শরীরের মাধ্যমে। আমরা হাঁটি, দৌড়াই, বসি, খাই, ঘুমাই - এগুলো সবই একশন। আবার কিছু একশন আছে যেগুলো আমাদের শরীর দিয়ে দেখা যায় না, দেখা যায় মুখভঙ্গির মাধ্যমে। সেই একশনটা ঘটে মনের মধ্যে। মনের সেই অনুভূতি চোখের তারায়, চাহনিতে, ভ্রুর সঞ্চালনে, ঠোঁটের ভঙ্গিতে ফুটে ওঠে। আমরা বুঝে নেই চরিত্রটির মনের অবস্থা।
অনুশীলনী :
০১) আপনার পরিবারের একজনকে বেছে নিন।
০২) দূর থেকে তার কাজকর্ম লক্ষ্য করুন।
০৩) সে যা যা করছে সেটা লিখে ফেলুন।
০৪) তার কাজের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অন্য কেউ কী করছে ? সেটাও লিখুন।
০৫) এই সব কাজ করতে গিয়ে তার চেহারার ভঙ্গির কী কোন পরিবর্তন হচ্ছে ? সেই পরিবর্তন ও ভঙ্গিটি লিখুন।
০৬) তার এসব কাজের সঙ্গে কোন কোন বস্তু জড়িত হয়ে পড়ছে। যেমন : ফোন, কম্পিউটার, থানা-বাসন, টেবিল চেয়ার, বই-কলম ইত্যাদি। সে যে সব বস্তু ব্যবহার করে কাজ করছে সেই বস্তুগুলোর নামও লিখুন।
সংলাপ :
আপনি যেভাবে কথা বলেন, সেটা লিখে ফেললেই হয়ে যাবে সংলাপ। সুতরাং সিনেমার চরিত্রগুলো পরস্পরের সাথে যে কথোপকথন করে সেটাই সংলাপ। সিনেমায় সংলাপ তথ্য দেয়, গল্পকে এগিয়ে নেয় এবং ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়।
সিনেমার সংলাপ তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচ্য : (সংলাপের কাজ)
০১) গল্প এগিয়ে নেয়। ০২) চরিত্রকে প্রকাশ করে। ০৩) ঘটনা ও চরিত্র সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দেয়। ০৪) আমাদের চারপাশের বাস্তব চরিত্রের মতো সংলাপ হবে। ০৫) আগের সংলাপের সাথের পরের সংলাপের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। ০৬) বিভিন্ন ধরনের চরিত্র বিভিন্ন রকম করে সংলাপ বলবে। ০৭) চরিত্র কিভাবে সংলাপ শোনে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ।
সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করলে এবং নানা চরিত্র নানা ভাষায় কথা বললে বৈচিত্র্য তৈরি হয়।
অনুশীলনী :
০১) জনসমাগম আছে এমন একটা জায়গায় যান। যেমন : রেল স্টেশন, বাস স্টেশন বা কোন থিম পার্ক।
০২) কয়েকজনের কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করুন।
০৩) রেকর্ডকৃত কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনুন। খেয়াল করে দেখুন একেক জন একেকভাবে কথা বলছে।
০৪) রেকর্ড করা প্রত্যেকের সংলাপ লিখে ফেলুন। বুঝতে কি পারছেন মানুষ বাস্তবে কিভাবে কথা বলে ?
পর্ব -০৪
মন-ভোলানো দর্শক থেকে মগজ খাটানোর দর্শক : আরও জ্ঞানের নেশা
এবার কিছু জ্ঞানের কথা বলার আগে পৃথিবী বিখ্যাত দুটি চলচ্চিত্র দেখে নিন। প্রথমটি হল প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের “হীরক রাজার দেশে” এবং আরেকটি হল বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জ্যামস ক্যামেরনের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র “টাইটানিক”।
কিভাবে দেখবেন চলচ্চিত্র ?
এতকাল আপনি মনের মাধুরী মিশিয়ে চলচ্চিত্র দেখেছেন, মগজ খাটান নি। এবার মগজ খাটিয়ে চলচ্চিত্র দেখবেন। দর্শক হিসেবে নয়, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে চলচ্চিত্র দেখবেন।
সেভাবে দেখার একটা সাধারণ নিয়ম আছে।
অনুশীলনী :
০১) কাগজ কলম নিন।
০২) সত্যজিৎ রায়ের “হীরক রাজার দেশে” চলচ্চিত্রটি আপনার ডিভিডি প্লেয়ারে চালু করুন।
০৩) প্রথম দৃশ্য থেকে ধীরে ধীরে দেখুন। বারে বারে থামুন।
০৪) শটগুলো লিখে ফেলার চেষ্টা করুন।
একবার ক্যামেরা চালু হওয়ার পর ক্যামেরা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত যে অংশটুকু গৃহীত হয়, সেটাই একটি শট।
শটগুলো লেখার ক্ষেত্রে ক্যামেরা দূরত্ব , ক্যামেরা কোণ ও ক্যামেরা সঞ্চালন বিবেচনা করুন।
বস্তু থেকে ক্যামেরা দূরত্বের উপর ভিত্তি করে শটের অনেকগুলো নাম দেয়া হয়েছে।
যেমন :
ক্যামেরা দূরত্বের উপর ভিত্তি করে শটের বিভাজন :
০১) এক্সট্রিম লং শট (অতি দূরবর্তী শট) : একটা পুরো গ্রাম, প্রান্তর ইত্যাদি দেখানোর জন্য দূর থেকে যে শট নেয়া হয় সেটাই এক্সট্রিম লং শট।
এক্সট্রিম লং শট ছাড়া অন্য সব শট বোঝার জন্য মানুষের শরীর থেকে ক্যামেরা দূরত্ব বিবেচনা করা হয়। সেই দূরত্বের কারণে শরীরের কতটুকু ক্যামেরা ধারণ করা হচ্ছে সেটা বিবেচনা করে শটগুলোর নামকরণ করা হয়েছে।
০২) লং শট : ফ্রেমে একটি মানুষের পুরো শরীর আসবে। সেই সাথে মানুষটির পেছনের বেশ কিছু জায়গা এবং সামনে বেশ কিছু জায়গা ফ্রেমে থাকবে। এটাই লং শট।
০৩) ফুল শট : মানুষের পা থেকে মাথা পর্যন্ত শট। মানুষের সামনে কোন দৃশ্য বা ফোরগ্রাউন্ড এই শটে থাকে না। লং শটের ফোরগ্রাউন্ড বা সামনের জায়গা ছেটে দিলেই সেটা ফুল শট হয়ে যায়।
০৪) মিড লং শট : পায়ের পাতার উপর থেকে ও হাঁটুর নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত শটকে মিড লং শট বলে।
০৫) মিড শট : হাঁটুর উপর ও কোমরের নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত শটকে মিড শট বলে। তাছাড়া বসা অবস্থায় যে কোন শটকেও মিড শট বলে।
০৬) মিড কোজ শট : মিড শটে একটি মানুষ না থেকে যদি একাধিক মানুষ থাকে তবে তাকে মিড কোজ শট বলে।
০৭) কোজ শট : নাভির উপর থেকে মাথা পর্যন্ত শটকে কোজ শট বলে।
০৮) কোজ আপ : বুক থেকে মাথা পর্যন্ত শটকে কোজ আপ বলে।
০৯) টাইট কোজ আপ : গলার নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত শটকে টাইট কোজ আপ বলে।
১০) বিগ কোজ আপ : থুতনি থেকে কপাল পর্যন্ত শটকে বিগ কোজ আপ বলে।
১১) এক্সট্রিম কোজ আপ : শুধুমাত্র ঠোঁট, চোখ বা গাল ইত্যাদির শটকে এক্সটিম কোজ আপ বলে।
ক্যামেরা কোণের উপর ভিত্তি করে শটের বিভাজন :
০১) হাই এঙ্গেল শট : আই লেভেল থেকে ক্যামেরা উপরে স্থাপন করে নিচের দিকে শট নিলে তাকে হাই এঙ্গেল শট বলে।
০২) লো এঙ্গেল শট : আই লেভেল থেকে ক্যামেরা নিচে স্থাপন করে উপর দিকে শট নিলে তাকে লো এঙ্গেল শট বলে।
০৩) স্ট্রেইট এঙ্গেল শট বা ফ্রন্ট এঙ্গেল শট : আই লেভেল বরাবর ক্যামেরা স্থাপন করে শট নেয়া হলে সেটা স্ট্রেইট এঙ্গেল বা ফ্রন্ট এঙ্গেল শট।
০৪) টপ শট : হাই এঙ্গেল শটের চূড়ান্ত অবস্থা হল টপ শট। একেবারে মাথার উপর থেকে শট নেয়া হলে তাকে টপ শট বলে।
ক্যামেরা সঞ্চালনের উপর ভিত্তি করে শটের বিভাজন :
ক্যামেরা সঞ্চালন ২ প্রকার : ০১) নিজের অক্ষের উপর ক্যামেরা সঞ্চালন, ০২) ক্যামেরার স্থান পরিবর্তন।
০১) নিজের অক্ষের উপর ক্যামেরা সঞ্চালন :
ক) প্যান : নিজের অক্ষের উপর ক্যামেরার আনুভূমিক সঞ্চালনকে প্যান বলে। আমরা যে রকমভাবে ডান থেকে বায়ে বা বা থেকে ডানে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই, ঠিক সেভাবে ক্যামেরা এক পাশ থেকে অন্য পাশে সঞ্চালন করাকেই প্যান বলা হয়।
খ) টিল্ট আপ/ টিল্ট ডাউন : নিজের অক্ষ বরাবর ক্যামেরা নিচ থেকে উপরে উঠলে টিল্ট আপ এবং উপর থেকে নিচে নামলে টিল্ট ডাউন বলে। আমরা যেভাবে ঘাড় উচু করে আকাশ দেখি সেটাকে ক্যামেরা করলে টিল

লিংক

Monday, November 21, 2016

গল্পের জরুরী কথা

 ছোটগল্প লেখার নিয়মকানুন

সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছোটগল্প। এর মাধ্যমে লেখক মানব জীবনের সেই অংশ তুলে ধরেন যা শাশ্বত জীবন আর মানবতাবোধের মূর্ত কিংবা বিমূর্ত ছবি। ছোটগল্পকে কোনো সংজ্ঞার নিয়মকানুনে বাঁধা যায় না। এর বিচরণ বহুমাত্রিক। তারপরও এর একটি রূপ তুলে ধরার জন্য আমরা প্রায়ই রবিঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘বর্ষাযাপন’ কবিতার সেই পঙ্ক্তিগুলো স্মরণ করি যেখানে বলা হয়েছে:

‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল-
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি,
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ-
অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।’


রবিঠাকুর এই কথাগুলো বলেছেন, ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ১৭ই জ্যৈষ্ঠ। আজও ছোটগল্পের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে আমাদের কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলোর উল্লেখ করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে ছোটগল্প জীবনের একটি খণ্ডিত অংশ হতে পারে। সেই অংশ দিয়ে জীবনের বিশাল রূপ দৃশ্যমান হয়। যেন অনেকটা সেই ছোট জানালা যা দিয়ে বিশাল আকাশটা দেখা যায়।

আমাদের জীবনপ্রবাহে হাজার হাজার ঘটনার, উপলব্ধির সেই অংশটি ছোটগল্পের উপাদান যা জীবন আর মানবতাবোধের পটভূমিকায় বিশেষত্ব লাভ করেছে। এখানেই এর মহত্ব এবং তাৎপর্য। এখানে কোনো তাত্ত্বিক কথা নেই, ঘটনার অতিরঞ্জিত বর্ণনা নেই এবং কোনো উপদেশবাণীও নেই। লেখক গল্পের ঘটনা, চরিত্র আর মার্জিত বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেন যবনিকার শেষপ্রান্তে। তারপর যেন মনে হবে, শেষ পরিণতিটা আর একটু জানা হলে ভালো হতো। বস্তুত লেখক সেটি পাঠকের জন্য ছেড়ে দেন। পাঠক ছোটগল্প পড়তে গিয়ে নিজের মধ্যে যে ভুবন তৈরি করেন সেখানে একটি সমাপ্তি বা উপসংহার টেনে নিতে পারেন যেখানে তৃপ্তির অতৃপ্তির একটি প্রভাব থেকে যায়।

ছোটগল্পে এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট এ্যকশনের মাধ্যমে একটি ঘটনা বা কাহিনীর বর্ণনা হয়ে থাকে। লেখক এই কাহিনী বা গল্প সেই সুনির্দিষ্ট এ্যকশনের ধারাবাহিকতার ক্রমানুসার ধরে লেখেন। আর এটি বলতে গিয়ে এক বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ ঘটান এবং তাদের দ্বারা সেই ঘটনাক্রম ঘটে থাকে। এই ঘটনাক্রম যে এ্যকশনের মাধ্যমে ঘটে থাকে আর পরিশেষে একটি কাহিনীর সুবিন্যস্ত রূপ দেখা যায় তাকে বলা হয় ‘প্লট’। ঘটনাগুলো কিছু ব্যক্তি বা চরিত্রের দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে থাকে। এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের স্ব স্ব নিজস্বতা রয়েছে, যেমনভাবে রয়েছে তাদের পৃথক পৃথক ভূমিকা। তারা একেকজন একেকমতো কথা বলে। তাদের চেহারা আমাদের পরিচিত পরিবেশ থেকে তুলে নেয়া অথবা কল্পনার জগৎ থেকে। তারপরও লেখকের লেখার স্টাইলে এই ব্যক্তিগুলো আমাদের চোখে স্বতন্ত্ররূপে মূর্ত হয়ে উঠে। তাদের এক একটি চরিত্র পাঠকের চোখে পৃথকভাবে ভেসে উঠে। এই চরিত্রগুলো গল্পের প্রাণ। তারা গল্পের মাঝে যেমন নির্দিষ্ট একটি ফ্রেমে বাঁধা থাকে তেমনভাবে সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক স্থানের মাঝেই তাদের বিচরণ। সুতরাং সময় এবং স্থানের ভূমিকা ও গুরুত্ব গল্পের কাহিনীকে জীবন্ত করে থাকে যাকে আমরা বলতে পারি ছোটগল্পের সেটিং। পরিশেষে যে কথাটি লেখক বলতে চান অথবা যা পাঠকমনে জেগে উঠতে পারে তা গল্পের মূল বক্তব্য বা থীম। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন গল্প রয়েছে যেখানে লেখকগণ বিভিন্ন সময়ের হাজারও স্থানের ছোটগল্প লিখেছেন এবং লিখছেন। আর এসব ছোটগল্প যে বিচারেই বিশ্লেষণ করা যাক না কেন সেটা কখন, কোথায় কিংবা স্টাইল ও পরিধি ধরে বিচার করলেও উপরোক্ত উপাদানগুলো পাওয়া যাবে। মুলত এগুলো ছোটগল্পের মৌলিক উপাদান। বিষয়টি আরও একটু পরিষ্কারের চেষ্টা করা যাক।

একটি ছোটগল্পে এমন কি বড়গল্পেও মূলত চারটি উপাদান থাকে। এগুলো হলো ১) প্লট 
২) চরিত্র 
৩) সেটিং 
৪) থীম। 
এগুলো ছোটগল্পকে জীবন্ত ও সুখপাঠ্য বৈশিষ্টমণ্ডিত করে।
১) প্লট (Plot):
এটি হলো গল্পের মেরুদণ্ড। আভিধানিকভাবে প্লট বলতে বোঝায়, যে ঘটনাসমূহ ধারাবাহিকতার ক্রমানুসার ধরে গল্পের মধ্যে প্রকাশিত বা বিকশিত হয় তাই প্লট। লেখক এখানে ঘটনাক্রমগুলো অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে এক এক করে লেখেন। এটি কোনোক্রমেই এলোমেলো হয় না। এটি কাহিনীর প্রয়োজনে কোনটি আগে কোনটি পরে লেখক তা তার দক্ষতার গুনে সাজিয়ে থাকেন। এই সুবিন্যস্ত ধারাক্রম কাহিনীকে একটি পরিণতি বা সমাপ্তির দিকে নিয়ে যায়। তাই লেখককে গল্প লেখার সময় কাহিনীর একটি ধারাক্রম সাজিয়ে নিতে হয়। তিনি গল্পের মূল থীমকে লক্ষ্য করে কোথায়, কখন ও কোন্ ঘটনার বিবরণ দেবেন তা দক্ষতার সাথে নির্ধারণ করেন।

লেখকগণকে বেশিরভাগ ছোটগল্পে প্লট সাজানোর জন্য পাঁচটি কাঠামো বা উপাদান অনুসরণ করতে দেখা যায়। এগুলো হলো: ক) ভূমিকা বা শুরু খ) ঘটনার আরোহণ গ) চরম পরিণতি বা ক্লাইমেক্স ঘ) ঘটনার অবরোহণ ঙ) সমাপ্তি বা পরিশেষ।

ক) ভূমিকা বা শুরু: 
ছোটগল্প শুরু করতে হয় একটি আকস্মিক ঘটনা বা ঘটনার কথা দিয়ে যাতে পাঠক খুব সহজেই পরবর্তী লেখাগুলোয় আকর্ষিত হতে পারেন। এটি শুধু যে ঘটনার কথা হতে হবে এমন কথা নেই, সেটি চরিত্র বর্ণনা, কাহিনীর পরিস্থিতি, সংঘাতময় কোনো কথা, সামগ্রিক কাহিনীর সেটিং অথবা গল্পের থীমের বক্তব্য দিয়েও শুরু করা যেতে পারে যেখানে তা পাঠকের কাছে আকস্মিক বিস্ফোরণের মতো মনে হতে পারে এবং তিনি আগ্রহের সঙ্গে গল্প বা কাহিনীর পরবর্তী অংশে সহজে প্রবেশ করতে পারেন।

খ) ঘটনার আরোহণ: 
গল্পে ঘটনা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ অংশে এটির সূত্রপাত ও তার এগিয়ে যাওয়া দেখতে পাওয়া যায়। পাঠক লেখকের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার মধ্যে সংশ্লিষ্ট হয়ে যান। তার চোখের সামনে ঘটতে থাকে এক একটি ঘটনা। এই ঘটনাগুলো হতে হয় আকর্ষণীয়, প্রয়োজনানুগ, বাহুল্যমুক্ত, কাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট বা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব ঘটনা ধারবাহিকভাবে ঘটতে ঘটতে একটি পরিণতির দিকে অগ্রসরমান থাকে। লেখক মূলত ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এখানে সেই ঘটনাগুলোর জন্য চরিত্র নির্মাণ করেন অথবা সৃজিত সেই চরিত্রগুলো ঘটনা ঘটিয়ে চলে। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মিল-অমিল ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত গল্পের কাহিনীকে একটি চূড়ান্ত পরিণতি দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। লেখক যা বলতে চেয়েছেন গল্প শেষে পাঠক তা সহজে আবিষ্কার করেন।

গ) চরম পরিণতি বা ক্লাইমেক্স:
ছোটগল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি। এখানে লেখক ঘটনার যে ধারানুক্রম বর্ণনা দেন এবং যেখানে ঘটনা ও চরিত্রগুলোর মধ্যে মিল-অমিল ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত, চরিত্রগুলোর নিজ নিজ স্বকীয়তা ও তাদের স্বতন্ত্র ভূমিকা গল্প বা কহিনীকে পাঠকের মনন জগতে চাক্ষুস বা জীবন্ত করে চলে তার চূড়ান্ত ও আবেগময় এক পরিণতি আবহ তৈরি হয়। পাঠক এখানে গল্পের ও চরিত্রের মধ্যে সমস্যা বা বর্ণিত ঘটনার একটি চরম রূপ দেখতে পান। ঘটনা ও চরিত্রগুলোর মধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন এ্যকশনের এই চরম রূপ পরবর্তীতে কাহিনীর পরিণতি বা শেষ নির্ধারণ করতে সহায়ক হয়।

ঘ) ঘটনার অবরোহণ: 
ছোটগল্পে বর্ণিত কাহিনীর চরম পরিণতি নির্ধারণ করে দেয় যে, ঘটনাগুলোর শেষ কিভাবে হতে যাচ্ছে। এখানে বর্ণিত কাহিনী এবং তার মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রগুলোর মিল-অমিল ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিম্নমুখি বা সমাধানমূলক হতে থাকে। পাঠককে একটি চূড়ান্ত পরিণতি তা স্বস্তিদায়ক বা আনন্দের বা বিষাদের হতে পারে সেদিকে ধাবিত করে। তিনি বুঝে নিতে পারেন যে গল্পের শেষ কোথায় ও কিভাবে হতে যাচ্ছে।

ঙ) সমাপ্তি বা পরিশেষ: 
ছোটগল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না। পাঠকের মনে একটি অশেষের জিজ্ঞাসা বা অতৃপ্তি রেখে দেয় আর প্রকৃতপক্ষে এখানেই ছোটগল্পের সার্থকতা। কাহিনীর সূত্রপাত, ঘটনা ও চরিত্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন এ্যকশন, সেসবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সামঞ্জস্য ছোটগল্পকে যে পরিণতির দিকে নিয়ে যায় মূলত এটিই সেই কাহিনীর বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত। লেখককে নির্ধারণ করতে হয় তিনি আসলে এই কাহিনীর দ্বারা কী বলতে আগ্রহী এবং তিনি কোথায় কোন্ অবস্থানে থেকে সেই সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য বলবেন। এটিকে সমগ্র কাহিনীর মূল প্রতিবাদ্য বলা যেতে পারে।

একটি ভালো প্লটের বৈশিষ্ট:
ছোটগল্পে ‘সংঘাত’ প্লটের জীবন হিসেবে অভিহীত। গল্পের কাহিনীর মধ্যে যে ঘটনা বলা হয় ও যেসব চরিত্র সৃজন করা হয় সেগুলোর মধ্যে একটির সাথে আর একটির সংঘাত গল্পের মূল পরিণতির জন্য অবশ্যম্ভাবী। এই এ্যকশনগুলো না হলে কাহিনী অগ্রসর হতে পারে না। এই সংঘাতগুলোর কী পরিণতি হচ্ছে, চরিত্রগুলো তাদের অবস্থান থেকে আর কোথায় যাচ্ছে অথবা সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছে কি না তা জানতে পাঠক আগ্রহ নিয়ে থাকেন। লেখক সেগুলোকে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেন। গল্পের প্লট সমস্যা বা ঘটনার মধ্যে আবর্তিত হয়। ঘটনার আরোহণ সংঘাতের উপর ভিত্তি করে চলে ও কাহিনীকে গতিশীলতা এনে দেয়। এখানে চরিত্রগুলোর জীবনে নানান সংঘাত অথবা গল্পে বর্ণিত কাহিনীর সংঘাত প্রধান উপজীব্য।

একটি ভালো প্লট র্নিমাণের দক্ষতা সংঘাতগুলো সাজানোর উপর নির্ভর করে। এই সংঘাত দু’ভাবে হতে পারে: ১) কাহিনীর মূল ঘটনা বা কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আবর্তিত করে অথবা 
২) কাহিনীর মূল ঘটনা বা কেন্দ্রীয় চরিত্রকে যা বিরোধিতা করছে তাকে ঘিরে। তবে এই সংঘাতের মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র সবসময় পাঠকের সহানুভূতি পেয়ে থাকে। এটি অনেকটা গল্পে বর্ণিত নায়ক ও ভিলেনের মধ্যে সম্পর্কের মতো।

সংঘাত দু ধরনের হতে পারে: ১) বাহির হতে সংঘাত: যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র বা অন্যান্য চরিত্রগুলোর নিজেদের কোনো হাত নেই এবং তা ঘটনা বা বিপরীত চরিত্র কর্তৃক আরোপিত। এখানে এই চরিত্রগুলো বাহির হতে আরোপিত সংঘাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। সেজন্য সংগ্রাম করে। 

২) অভ্যন্তরীণ সংঘাত: যেখানে কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র বা চরিত্রগুলো নিজেদের মধ্যে এই সংঘাত তৈরি করে ও ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানে চরিত্রগুলোর ভালোমন্দ লাগার অনুভূতি, বিশ্বাস, আশা-হতাশা, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ ইত্যাদির বর্ণনা হতে পারে।

সফল প্লট নির্মাণের কৌশল:
একটি ভালো গল্পের মূল ভিত্তি প্লটের সফলতার উপর নির্ভর করে। বলা যায়, পাঠক একটি জমজমাট গল্প পড়ে যখন অভিভূত হন তখন এটিই প্রমাণীত হয় যে, লেখক খুব সফলভাবে কাজ করে সার্থক প্লট নির্মাণে দক্ষতা দেখিয়েছেন। সফল প্লট নির্মাণের কয়েকটি কৌশল আছে। যেমন: 
ক) সাসপেন্স বা অনিশ্চয়তা 
খ) পরিণতির পূর্বাভাস 
গ) অতীতের কথা বা স্মৃতিচারণ 
ঘ) গল্পের কাঠামো 
ঙ) অবাক করা সমাপ্তি।

ক) সাসপেন্স বা অনিশ্চয়তা: ছোটগল্প শুরু করতে হবে আকস্মিক একটি কথা বা ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে যা পড়ে প্রথমে পাঠক চমৎকৃত হবেন ও গল্পের ভেতরে অজানা-অনিশ্চিত কী আছে তা জানার জন্য আগ্রহী হবেন। তাঁর ভেতরে গল্পের সম্পূর্ণ কাহিনী জানার জন্য একধরনের তাগিদ তৈরি হবে।

খ) পরিণতির পূর্বাভাস: পাঠককে এমন অনিশ্চিত, জটিল বা রহস্য আচ্ছন্ন কাহিনীতে নিয়ে যাওয়া যাবে না, যা থেকে তিনি বিরক্ত হন। গল্প হতে হবে তার চেনাজানা মানুষজন ও পরিবেশ থেকে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, কল্পনা ও রহস্যের জগৎ থেকে কিছু লেখা যাবে না। বস্তুত লেখক গল্পের কাহিনীতে অতিরিক্ত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা ও বর্ণনা দেবেন না। গল্পের কাহিনীতে পাঠককে ধীরে ধীরে নিয়ে যেতে যেতে লেখক গল্পের একটি পরিণতির আভাস দেবেন। এটি ভালো গল্পের জন্য জরুরি এবং তা পাঠকের মনের আকাঙ্ক্ষাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। লেখক গল্পের মাঝে মাঝে এমন কিছু ক্লু ছড়িয়ে দেবেন যা থেকে পাঠকের এই উপলব্ধি হয় যে, এটি তাঁর পরিচিত ভুবনের গল্প। তিনি অনুমান করতে পারেন যে, কাহিনীর পরবর্তী ধাপগুলো কী হতে যাচ্ছে।

গ) অতীতের কথা বা স্মৃতিচারণ: ছোটগল্পে এই কৌশলটি খুব সার্থকভাবে প্রয়োগ করা যায়। এখানে লেখক গল্পের সেই অংশটুকু বলতে পারেন যা কাহিনীর শুরুতে বলা হয়নি, কিন্তু কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুরোনো কথা বা ঘটনাগুলো বলা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল অনেক লেখক এই কৌশলটির সফল প্রয়োগ করেন যাতে পাঠকের মনে সেই পরিচিত মানুষজন আর ঘটনার বাস্তবতা দেখা যায়। এটি মূলত গল্পের প্লটের সেই পরিচিত অংশ যা পুরো কাহিনীর গতিময়তা দিয়ে থাকে।

ঘ) গল্পের কাঠামো: এটি হলো গল্পের ভেতরের গল্প অর্থাৎ লেখক যে গল্প বলতে শুরু করেছেন এবং সেজন্য নানান চরিত্র নির্মাণ করেছেন, সেই চরিত্রগুলোর নিজস্ব গল্প আছে আর সেসবের সুবিন্যস্ত উপস্থাপনা হলো গল্পের কাঠামো। ভালো প্লট একটি গল্পের কাঠামো ছাড়া তৈরি করা যায় না। এখানে লেখক গল্পের চরিত্র নির্মাণ ছাড়াও কল্পনাশক্তি, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-ব্যর্থতা, পরিবেশ ও আমেজ নির্মাণ করে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে থাকেন।

ঙ) অবাক করা সমাপ্তি: লেখক যে আকস্মিক ও আকর্ষণীয় বাক্য নিয়ে গল্পের সূত্রপাত করেছেন তার সমাপ্তিও টেনে দেবেন এক আকস্মিক সমাপ্তি দিয়ে, যা হয়তো পাঠকের কাছে বিস্মিত এক পরিণতির মতো লাগে। সতর্ক পাঠক এমন একটি সমাপ্তির প্রত্যাশা করেন।

২) চরিত্র (Character):
ছোটগল্পে যে কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে তা অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলো অপেক্ষা অনেক পরিস্ফুট ও স্বচ্ছ। মূলত গল্পের কাহিনী ও বর্ণনা তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এখানে লেখক সেই চরিত্রের পেছনের কথা ও বর্তমানের কথা বলেন। তার ভাবনা, উপলব্ধি, স্বপ্ন-সাধ, আশা-হতাশা, অভ্যাস, মনমানসিকতা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো গল্পের নিরিখে যেমন প্রযোজ্য তেমনভাবে লিখে থাকেন। একটি-দুটি কথাতে বা ঘটনাতে লেখক এই চরিত্রটির সার্বিক প্রতিচ্ছবি আঁকতে পারেন। অন্যান্য পার্শ্ব ও লঘু চরিত্রগুলোর কথা বাদ দেয়া যায় না, তবে তা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মতো বিশদ নাও হতে পারে। লেখক যে চরিত্র সৃজন করেন ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাকে চরিত্রায়ন বলা যায়। লেখক সাধারণত দুটি মৌলিক কৌশল অনুসরনের দ্বারা চরিত্রায়ন বা চরিত্র সৃজন করে থাকেন। 
১) সরাসরি চরিত্রের কথা বলা 
২) ঘটনা বা চরিত্রের ভাবনা, উপলব্ধি, স্বপ্ন-সাধ, আশা-হতাশা, অভ্যাস, মনমানসিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে পাঠকের কাছে চরিত্রটির মূর্ত রূপ তুলে ধরা।

গল্পের চরিত্র কাহিনীর প্রয়োজনে নানারকমের হতে পারে। লেখক নিজেই সৃষ্টি করেন তার কাহিনীর নায়ক-নায়িকা-ভিলেন-সহযোগিগণ কেমন মানুষ হবে। তারা কি পরিচিত ভূবনের নাকি কল্পনার জগতের? মূলত সফল গল্পের প্রয়োজনে পরিচিত ও বাস্তব বা বাস্তবের মতো চরিত্র সৃজন করা জরুরি। এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নানান ঘটনা, সংঘাত, মিল-অমিল গল্পের কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায় ও একটি পরিণতি দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে লেখকের অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তি অনেক কাজ করে থাকে। লেখক তার কাহিনীর প্লট অনুসারে চরিত্রের প্রতিচ্ছবিকে নানাভাবে মূর্ত করে তোলেন। যেমন:

১) প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্র: এই চরিত্রটি সমগ্র গল্পে একটি বিশেষ ও স্বতন্ত্র ভূমিকা নিয়ে এগোবে। তার কথাবার্তা ঘটনা সংঘটন ইত্যাদিতে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট প্রকাশ পাবে। এই চরিত্রটি গল্পের কাহিনীর উদ্দেশ্য ও পরিণতিতে বড় ও মূল ভূমিকা রাখে।
২) পারিপার্শ্বক চরিত্র: এই চরিত্র বা চরিত্রগুলো গল্পের কাহিনীর বিস্তৃতির জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু তার বা তাদের অবস্থান ও ঘটনা প্রবাহ গল্পে অনেকটা অতিথির মতো। তাদের ভূমিকা গোলাপ প্রস্ফুটিত হওয়ার পেছনে গাছকে মাটির রসে সঞ্জীবিত করার মতো নেপথ্য শক্তি। পাঠক তাদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ‘কম’ পরিচিত হন, তাদের সীমিতভাবে দেখেন ও শোনেন কিন্তু কাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের ভূমিকা অনেক বেশি ও জরুরি।
৩) সরল ও অপরিবর্তনীয় চরিত্র: গল্পে এ চরিত্রগুলোর অবস্থান এক মতো অর্থাৎ পাঠকের মনে তাদের একই ধাঁচ ও ছবি ফুটে উঠে।
৪) পরিবর্তনশীল চরিত্র: এই চরিত্রগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে একক ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র রূপলাভ করে থাকে।
৫) নিশ্চল বা স্থির চরিত্র: এ চরিত্রটির বৈশিষ্ট হলো এগুলো গল্পের মধ্যে পরিবর্তিত হয় না। নিশ্চল একটি ভূমিকা নিয়ে থাকে।
৬) গতিময় চরিত্র: এ চরিত্রটি গল্পের কাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন ঘটনার সূত্রপাত করে গল্পকে গতিশীল করে থাকে।
৭) স্টিরিওটাইপড্ বা ছাঁচে ঢালা চরিত্র: এ চরিত্রগুলো আমাদের অতি জানাশোনা ও পরিচিত ব্যক্তি যাদের আগমন, আচরণ খুব চেনা ও আগাম বলে দেয়া যায় যে, তারা কী করবে।

লেখক তার গল্পের কাহিনীর প্রয়োজন অনুসারে চরিত্রগুলোর সমাবেশ করেন। তাদের দ্বারা নানান কথা বলান, ঘটনা ঘটান এবং গল্পকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যান। এই চরিত্রগুলো কখনো সরাসরি বা প্রত্যক্ষ আবার কখনো প্রচ্ছন্ন বা পরোক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়। যেমন: আমরা যদি অধ্যাপকের একটি চরিত্র উপস্থাপন করতে চাই, তখন সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে বলতে পারি, তিনি একজন অধ্যাপক, কলেজে শিক্ষকতা করেন। আবার পরোক্ষভাবে যদি দেখানো যায় যে, তিনি কলেজের ক্লাসে পড়াচ্ছেন তাহলে সহজে বোঝা যায় যে চরিত্রটি কলেজের শিক্ষক বা অধ্যাপক।

৩) সেটিং (Setting):
গল্পের কাহিনীতে যে সময় ও স্থানের কথা বলা হয় অর্থাৎ ঘটনাটি কোন্ জায়গার এবং সময়ের সেটিকে গল্পের সেটিং বলা যায়। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে গল্পের কাহিনী অমুক জায়গায় অমুক সময়ে ঘটেছে বা ঘটছে, এমন একটি প্রেক্ষাপটকে গল্পের সেটিং বলে। সাধারণত লেখক কাহিনীর বাস্তবতার আবহ তৈরি করতে জায়গা ও সময়ের বর্ণনা করে থাকেন। গল্পের মধ্যে যদি বলা হয়, ফুটবল খেলার মাঠ, সময় বিকেলবেলা এবং ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে, তাহলে পাঠকের মনে ঠিক অনুরূপ একটি ছবি ভেসে উঠে। এই সেটিং’এর উপর চরিত্রগুলোর নানান ভূমিকা, ঘটনাপ্রবাহ, ধারনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে, তেমনভাবে বাস্তবানুগ মনে হয় এবং গল্প এগিয়ে চলে। পাঠক প্রথমেই এই সেটিং’কে ধরে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং ধীরে ধীরে মিশে যান। মূলত সেটিং’এর মাধ্যমে লেখক তার কাহিনীকে দৃশ্যমান করার সুযোগ লাভ করেন। কোনো কোনো লেখক সেটিং’কে ক্রমানুসারে ধীরে ধীরে উপস্থাপন করেন, প্রয়োজন মতো জমিয়ে বিবরণ দেন আবার কোনো কোনো লেখক খুব বেশি প্রাধান্য না দিয়ে চরিত্রগুলোর মাধ্যমে গল্পের সেটিংস কাহিনীতে তুলে ধরেন। তবে যেভাবেই হোক না কেন গল্পে সেটিং আবশ্যক।

কয়েকটি পদ্ধতিতে সেটিং গড়ে তোলা বা উপস্থাপন করা যায়। যেমন: 
১) ডায়লগ: গল্পের চরিত্র বা চরিত্রগুলোর কথার মাধ্যমে সেটিং তুলে ধরা যায়। দৃষ্টান্ত: একটি চরিত্র আর এক চরিত্রকে উদ্বেগের সাথে বলছে, এতরাতে না গেলেই কি নয়? 
২) শব্দের মাধ্যমে সেটিং তুলে ধরা যায়। দৃষ্টান্ত: দূর হতে ভেসে আসা ট্রেনের হুইসিলের শব্দে বোঝা যায় একটি ট্রেন কিছুক্ষণ পর চলে যাবে এবং জায়গাটা রেল ইস্টিশান বা লাইনের কাছাকাছি। গন্ধের বর্ণনা দিয়ে। দৃষ্টান্ত: তরকারি পোড়ার গন্ধের কথা দিয়ে লেখক রান্নাঘরের ছবি আঁকতে পারেন।

পাঠক গল্পের কাহিনীতে সেটিং’কে ধরে এগিয়ে যান কেননা মানুষের স্বভাব, ভিন্নতা, বসবাস, ভাবনা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, পেশা, পরিবেশ, পরিস্থিতি, জীবন প্রবাহ ও জটিলতা ইত্যাদির সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তারা গল্পের মধ্যে সেটিকে দেখতে পছন্দ করেন। গল্পের মধ্যে চরিত্রগুলোর ভাবনা ও এ্যকশন সেটিং’এর দ্বারা প্রভাবিত হয় অথবা উল্টোটিও হতে পারে যে, তাদের ওই সমস্ত ভাবনা ও এ্যকশন সেটিং তৈরি করছে। এটি কিভাবে সাধিত হয়, একটু দেখা যাক। ১) সময়: গল্পের কাহিনীতে বর্ণিত সময় গল্পের পুরো প্লটকে প্রভাবিত করে। দৃষ্টান্ত: গভীর রাতে গল্পের চরিত্র এক ভুতুড়ে বাড়িতে এসেছে। এখানে পাঠকের মনে ভয় মিশ্রিত এক কৌতূহলের সৃষ্টি করে। 
২) জায়গা বা স্থান: গল্পের কাহিনীকে এটিও প্রভাবিত করে। দৃষ্টান্ত: যানজটপূর্ণ সড়কের উল্লেখ করলে আমরা খুব সহজেই সেই দৃশ্যটি চোখে ভেসে উঠতে দেখি। 
৩) ঘটনা: ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ঘটনার সংঘটন সেটিং বুঝতে সহায়তা করে। যেমন: চলন্ত বাস থেকে এক যাত্রী লাফ দিয়ে নেমে গেল।

৪) থীম (Theme): 
একটি সার্থক ছোটগল্প তা সিরিয়াস বা সাধারণভাবে ভালো লেখা হলেও অবশ্যই সুখপাঠ্য। কেননা এটি মানুষের জীবন ও জগতের কথা বলে। পাঠক গল্পের কাহিনীতে বিধৃত ঘটনা, ঘটনার পেছনের ঘটনা, চরিত্র ও চরিত্রগুলোর বিভিন্ন এ্যকশন পড়েন এবং তাঁর নিজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, বিচার-বিবেচনা, জানাশোনা, দেখা বা অভিজ্ঞতার সাথে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মিলিয়ে নেন। মূলত জীবনের এই বিষয়টি যা গল্পে লেখা হয় সেটিই গল্পের থীম। পাঠক গল্প শেষ করার পর এটি বুঝতে পারেন যে, মূলত এই বক্তব্য বা আমেজ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই গল্পটি। তবে অধিকাংশ ছোটগল্পে গল্পের থীম সরাসরি বলা হয় না। এখানে পাঠক পড়া শেষে নিজেই সেটি তৈরি করে নেন। তিনি তাঁর ধী শক্তি বলে বক্তব্যটির একটি ছবি এঁকে নেন এবং সাধারণভাবে একটি উপসংহার বা সমাপ্তিতে আসেন। লেখক তার গল্পের থীম বেশ কিছু পদ্ধতিতে প্রকাশ করতে পারেন। 
১) সরাসরি গল্পের শিরোনাম বা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে মুল বক্তব্য সম্পর্কে আভাষ দিয়ে। 
২) গল্পের ভেতর কোনো একটি অংশে চরিত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মধ্য দিয়ে।
৩) গল্পের চরিত্রের কোনো উক্তি দিয়ে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় যথেষ্ট মনোযোগের দাবি রাখে। যেমন:
১) গল্পের একটি আকর্ষণীয় শিরোনাম একটি সম্পদ। এ কথাকে সামনে রেখে গল্পের শিরোনাম ঠিক করতে হয়। এটি হবে ছোট, আকর্ষণীয়, বিষয় ও থীম সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ গল্পটি যদি মঙ্গল গ্রহে অভিযান সম্পর্কিত হয় তাহলে ‘মঙ্গল গ্রহে অভিযান’ হতে পারে। যদি কোনো চরিত্রের বধু খোঁজা নিয়ে কৌতুক বা রম্য গল্প হয় তাহলে ‘বধু অন্বেষণ’ ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। শিরোনাম দেয়ার ক্ষেত্রে লেখকের দক্ষতা সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ। এমন শিরোনাম দেয়া উচিৎ যা শুধু আকর্ষণীয় হবে না, উপযুক্ত শব্দচয়ন ও বিন্যাসনির্ভর যা পাঠকের মনে কৌতূহল জাগাবে। শিরোনাম কখনোই দীর্ঘ ও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বলা হয়ে থাকে একটি ভালো শিরোনাম গল্পকে মূল্যবান করে তোলে।

২) লেখার বিষয়ে নির্ভুল বানান, সঠিক শব্দচয়ন ও মার্জিত বাক্যের ধারাবাহিকতা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ করা শ্রেয়। খাপছাড়া ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের বাহুল্য বর্জন করতে হবে। অনুরূপভাবে রিপিটেশন করাও বর্জনীয়।

৩) গল্পের আকার হতে হবে সহনীয় পর্যায়ের। তবে এক্ষেত্রে নানাজনের ভিন্ন ভিন্ন কথা রয়েছে। কেউ ছোটগল্পকে ১৫০০ থেকে ৩০০০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চান। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন যে, ছোটগল্প আকারে হবে ৩০০০ থেকে ৪০০০ শব্দের মধ্যে, কিন্তু কোনোক্রমেই ৩৬০০ থেকে ৪৩০০ শব্দের অতিরিক্তি হবে না। আবার এটাও দেখা যায় যে, কোনো কোনো ছোটগল্প মলাটবদ্ধ বইয়ের পৌণে একপৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে। কেউ কেউ এগুলোকে অনুগল্প বলে থাকেন। দেখা যায়, লেখক ছোটগল্প রচনায় তার পরিধির বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা আদায় করে নেন। তবে যারা সংবাদপত্রে ছোটগল্প লিখতে আগ্রহী তাদের উচিৎ হবে একটি ছোটগল্পের আকার ১৫০০ থেকে ১৮০০ শব্দের মধ্যে সীমিত রাখতে।

৪) গল্পে বর্ণিত বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, চরিত্রগুলোর বাস্তবতা যুক্তিযুক্ত করা উচিৎ। যে তথ্য ও তত্ত্ব গল্পে এসে যায় তা সঠিক হতে হবে। কেননা পাঠক আজগুবি বা ভুল তথ্য দ্বারা বিরক্ত হন। তেমনভাবে কোনো জ্ঞান দেখানো ও সেকেন্ড হ্যান্ড ইনফরমেশন দেয়ার চেষ্টা করা যাবে না।

৫) গল্পের কাহিনীতে নানান মিশ্র থীমের সমাবেশ না ঘটানোই শ্রেয়। একটি বক্তব্য একটি গল্পের জন্য যথেষ্ট। প্রয়োজনে ভিন্ন থীমের জন্য ভিন্ন গল্প লেখা যেতে পারে। গল্পে মূল বক্তব্যের বারবার উল্লেখ পরিহার করা দরকার। আবার ভাষার নানান কারুকাজ দেখাতে গিয়ে যেন দুর্বোধ্য বা প্রবন্ধের মতো কঠোর না হয়, সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে।

ছোটগল্প সাহিত্যের একটি অতি মূল্যবান অংশ। এর সম্ভাবনা ও পাঠক অনেক। ছোটগল্প শুরু থেকে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পথ পেরিয়ে চলেছে। এখন কোনো ফর্মুলায় ফেলে হয়তো ছোটগল্পের জ্যামিতি খোঁজা যায় না। তারপরও একটি কাঠামোকে লেখকগণ অনুসরণ করে থাকেন। তাঁরা স্ব-স্ব দক্ষতা, পছন্দ, লেখার স্টাইল ধরে ছোটগল্প পাঠকদের উপহার দিয়ে চলেছেন।
 
- মাহবুব আলী

Sunday, November 20, 2016

ভাল ছাত্র না হওয়ার উপকারিতা

  •  আপনি যদি মেধাবী হোন তাহলে দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পত্রিকায় তো প্রায়ই দেখা যায় অমুক মেধাবী ছাত্র সড়ক দূর্ঘনায় নিহত। কখনো লেখে না অমুক খারাপ ছাত্র দুর্ঘটনায় নিহত।
  • মেধাবী খেতাব পেলে স্কুল পালাতে অসুবিধা হবে কারণ তখন আপনাকে  সকল স্যারই চিনে ফেলবে। আপনি লাস্ট বেঞ্চে বসে ক্লাস অফ ক্লান খেলতে কিংবা ফেসবুকিং করতে পারবেন না। কারণ স্যারের স্পেশাল নজরদারিতে থাকবেন।
  • স্যার ধরেই নেবে কেউ না পারলেও আপনি পারবেন তাই বার বার আপনাকে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
  •  ভাল ছাত্ররা কখনো ফেল করে না তাই তারা কখনো জুনিয়র ব্যাচের আগুন সুন্দরীদের সাথে একই হলে বসে পরীক্ষা দিতে পারে না। এ সৌভাগ্য কেবল খারাপ ছাত্রদেরই হয়।
  • আপনি কিছু না পারলে কেউ খোঁচা দিয়ে বলতে পারবে না ‘স্যারদের তেল মেরে সিজিপিএ পাওয়া যায় ভালো ছাত্র হওয়া যায় না’।
  • সবশেষ কথা মেধাবী হলে জাতি আপনার থেকে অনেক কিছু আশা করবে আর মেধাবী না হলে কেবল জনসংখ্যা যা বিয়ে করলেই ল্যাটা চুকে যায়।
        
          রাজীব নন্দী

Wednesday, November 16, 2016

নেতা বিত্তান্ত

এক গবেষণায় দেখা গেছে - “এ দেশে যত নেতা আছে তত জনসংখ্যাও নাই!

আনাচে কানাচে, কোনায় কাঞ্চিতে, চিপায় চাপায় খাটের তলায় সবখানে নেতার ছড়াছড়ি। রাস্তায় বের হবেন পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে থাকবে নেতাদের মুখ। ইয়া বড় বড় ব্যানারের নিচে নন ভোটার বস্তিবাসী কিংবা বাস্তুহারা লোকজন মাঝে মাঝে আশ্রয় নিয়ে হয়ত নেতাদের এক গাল আশীর্বাদও করে দেন! আগে প্রথম দেখায় লোকজনের নাম জিজ্ঞেস করত, তারপর জিজ্ঞেস করত ফেসবুক আইডি, এখন জিজ্ঞেস করে কোন পদে আছেন! প্রতিদিন যত নেতা গজায় তত বাচ্চাও নাকি পয়দা হয় না বলে আদমশুমারী জানিয়েছে। লোকাল বাসে বসলে পাশে বসা লোকটাকে গেজ করার চেষ্টা করি, উনি কিসের নেতা হতে পারেন। মাঝে মাঝে পিচ্চি বাচ্চা হেলপারদের ধমক টমক দিয়ে নিজেই বুঝিয়ে দেন উনার পদ কত বড়!

কীভাবে চিনব কে নেতা আর কে নেতা না? রিকশায় উঠেও ভয়ে থাকি উনি আবার রিকশা চালক সমিতির কোন বড় পদের নেতা টেতা হন কিনা খোদাই জানে! পাবলিক টয়লেটে হিসু করতে গিয়ে ভাবি উনি হয়ত জাতীয় পাবলিক টয়লেট সমিতির সভাপতি-টতিও হতে পারেন। কিন্ডার গার্টেনের সামনে গিয়েও আমি খুঁজি কিন্ডার গার্টেন ছাত্রনেতাদের কোন পোস্টার মোস্টার পাই কিনা! কোথাও নেতামুক্ত পরিবেশ পাই না। কোন কবি যেন কবিগান ধরেছিলেন, "নেতা বাড়ছে রে বাড়ছে রে বাংলায়, পিঁপড়ার মত বাড়ছে নেতা বাস (বাঁশ) করে বাংলায়, নেতা বাড়ছে রে।....!"

তো জাতি এত নেতা দিয়ে কি করবে জাতি নিজেও জানে না। গুগল খুঁজেও যেখানে একজন আমজনতা পাওয়া ভার সেখানে উন্নয়ন কে ঠেকায়। তো নেতার বৈশিষ্ট্য কি? না নেতাদের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তারা যা করবে সেটাই জোস সেটাই নেতামি। কখনো কখনো দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে নেতাবৃন্দের। সব নেতা মিলে যদি জাতীয় নেতা সমিতি গঠন করে দেখা যাবে সতের কোটি পদ হয়ে গেছে। গিনেস বুকে নাম উঠে গেছে আমাদের। বিদেশিরা ভয়ে কাচুমাচু করতেছে নেতা সমুদ্রের জোয়ার দেখে। কি সুন্দর দৃশ্য হত তাই না?

কবি কলমের খোঁচায় কালি নষ্ট করে এমনি এমনিতো বলে যান নাই...
"এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
আনাচে কানাচে নেতা সবাই নেতার উর্বর ভূমি।"


নেতা বিত্তান্ত 

কোথাও আস্থা নেই

কোথাও আস্থা নেই
কি ঘরে কি বাইরে
কি নরে কি মাইরে।
কি আইনে কি বেআইনে
কি সাইনে কি পেআইনে।

কোথাও আস্থা নেই
কি রাজায় কি প্রজায়
কি সাজায় কি সজ্জায়
কি জনগণে কি জনমনে
কি বিশ্বাস্যে কি মরনপণে।

কোথাও আস্থা নেই
কি প্রেমিকে কি প্রেমিকায়
কি সেবকে কি সেবিকায়
কি পাহাড়ে কি অট্রালিকায়
কি বাহারে কি গড্ডলিকায়।

কোথাও আস্থা নেই
কি পিতায় কি পুত্রে
কি মিতায় কি সূত্রে
কি গণিতে কি গণিকায়
কি শনিতে কি ভণিতায়।

কোথাও আস্থা নেই
কি পশুতে কি মানুষে
কি বায়ুতে কি ফানুশে
কি বর্বরতায় কি সভ্যতায়
কি সুশীলে কি অসভ্যতায়।

কোথাও আস্থা নেই
কি প্রকৃতিতে কি যন্ত্রে
কি ভূপতিতে কি মন্ত্রে
কি স্বর্গে কি নরকে
কি মর্গে কি সড়কে।

আস্থা নেই জন্মে আস্থা নেই মৃত্যুয়
আস্থা নেই মনিবে আস্থা নেই ভৃত্যয়
আস্থা নেই একায় আস্থা নেই জামাতে
আস্থা খুঁজি কেবল আমি আমাতে।


16/11/16

Monday, November 14, 2016

প্যাঁচআল

সোমবারের সমকাল পত্রিকার ট্যাবলয়েড “প্যাঁচআল” এ আমার লেখা।

বিষয়ঃ হাতের লেখা খারাপ হওয়ার উপকারিতা।

বিষন্ন অতীত

.......বিএনপি শেষ যেবার ক্ষমতায় এলো, সেই নির্বাচনের আগে আমি আমার ভোলাতে নিজ কানে শ্লোগান দিতে শুনেছি, "একটা একটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর!" সম্ভবত প্রাইমারীতে পড়ি তখন। এখন ভাবি, দেশ তখনও স্বাধীন ছিল !

Saturday, November 12, 2016

ডিম পাহাড় (বান্দরবান) সফরনামা

ডিম পাহাড়ে একটি মাচাংয়ে আমরা
চট্রগ্রামে ইন্টার্ণশীপে আসার প্রথম কারণ ছিল ঘোর্ঘাুরি করা। সে হাওয়ায় পাল দিয়ে দিলেন প্লাবন পাল দাদা। প্রথম ট্রেকিং সীতাকুন্ডের পর দ্বিতীয় ট্রেকিং করে আসলাম বান্দরবান থেকে। উদ্দেশ্য ডিম পাহাড় এবং হাসিক আলীর সুরঙ্গ। বৃহস্পতিবার রাত আটটার বাসে চট্রগ্রাম নুতন ব্রীজ থেকে কক্সেসবাজারের চকরিয়ায় যখন পৌছলাম রাত প্রায় সাড়ে এগারটা। চকরিয়া প্লাবন  দা’র কলিগের চার তালা ছাদের উপর রুমে রাত কাটিয়ে দিলাম আমরা আট জনের টিম। ভোর না হতেই কানে আসল এলার্ম। না ঘড়ির এলার্ম নয় ট্রেকিং টিমের এলার্ম। ব্যাচেরের সঙ্গী ঐ বিছানা ছেড়ে কেইবা এত ভোরে উঠতে চায় তবুও যে উঠতে হল। ভোরে ভোরে বের হয়ে পড়লাম চকরিয়া থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। প্রথমে চকরিয়া থেকে আলী কদম বাস ষ্ট্যান্ড নেমে নাস্তা করলাম। তারপর সেখান থেকে জিপে করে ডিম পাহাড়ের সান্নিধ্যে যাত্রা শুরু। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল তিন হাজার টাকা দিয়ে জিপ ভাড়া করে আট জনই জিপের ছাদে উঠে পড়লাম। আশী কদম থেকে থানচির দুরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। আমরা তারও ৭ কিমি আগে ডিম পাহাড়ে নেমে যাই। মানে আমাদের পাহাড়ে যেতে হয়েছে মোট ২৩ কিমি। শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে আসতেছে জিপকে কেবল উপরের দিকেই উঠতেছে দেখে। কখনও বিশ কখনও ত্রিশ কখনও চল্লিশ কিংবা তারও বেশি ডিগ্রি বাঁকা রাস্তা ধরে জিপ উপরের দিকে যাচ্ছে। সাপের মত আঁকাবাকা পথ আর উচু নিচু তো আছেই। কখনও পথের দু’দিকেই খাদ। বাস পথ হারালেই প্যারাসুট ছাড়া শূন্যে ভাসতে হবে সবাইকে। এ ভ্রমন বর্ণনাতীত। নিজে উপভোগ না করলে বলে কিংবা লিখে বুঝানো অসপসিবল।

মাচাং
                পুরো জায়গাটাতেই সেনাবহিনীর টহল। পাহাড়ে ঢুকতেই থিংকু পাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে পারমিশন নিতে হয়। তাই কিছু সময়ের জন্য জিপের সিটগুলো আমাদের ছোঁয়া পেল। সবশেষে  জিপের ঘূর্ণন থেমে যেতেই আমাদের পাহাড় ট্রেকিং শুরু ডিম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। উঁচু নিচু পাহাড় ভেঙ্গে একটা মাচাং এর মত ঘর পাওয়া গেল। সেটাতে বসে কলা, মোজো, বিস্কিট, পানি ও লাপা(!) দিয়ে হালকা নাস্তা শেষ করলাম। কিছু সময় ফটোসেশন করে দ্বিতীয় দফায় পাহাড়ের বুকে হামলা দিয়ে পৌছে গেলাম ডিম পাহাড়। না কোন ডিম নেই এ পাহাড়ে তবুও কেন এ নাম তা অনন্ত জলিলও গুগোল এবং ভূগোল খুঁজে বের করতে পারে নাই। আমাদের ধারণা এখানে খুব কম সংখ্যক লোকেরই পদচারনা পড়েছে। তারপর প্রায় তিনটা নাগাদ আমরা আবার আলী কদম বাস ষ্ট্যান্ডে এসে পৌছলাম।  না এ পাহাড়েরর কোন দুঃখ নেই বোধহয় নচেৎ কোন ঝরনা খুঁজে পেলাম না কেন? তবে দুঃখ আছে পাহাড়িদের বুকে। সমুদ্র পৃষ্ঠা থেকে প্রায় ২৫০০ ফুট উপরে বসত বাড়ি বানিয়ে বসবাস করে মানুষ। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা। কোন আধুনিকতার ছোঁয়া নেই সেখানে। নেই শিক্ষার ছোঁয়াও। আমাদের ডিম পাহাড়ের গাইড ছিল আনোয়ার । অল্প বয়সে তার কথাবার্তায় কত বাস্তবতার নির্মমতা টের পেয়েছি আমি। অতো উঁচুতে বসবাস করেও জীবনযাত্রার মান নিম্নই রয়ে যায় পাহাড়িদের। পরের পোস্টে শুনাবো লাইফের সেরা এডভেঞ্চার আলীর গুগার কাহিনী। অপেক্ষায় থাকুন।
ডিম পাহাড়ে আমরা

সীতাকুন্ড সফরনামা


গতকাল সীতাকুন্ড পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে গিয়ে মাংসাসী প্রাণির আক্রমনের শিকার হই। প্রায় দশ পনেরো মিনিট পরে ব্লিডিং বন্ধ হয়। জোঁকের স্যালাইভারি গ্লান্ডে হিরুডিন নামক এন্টিকোয়াগুলেন্ট থাকে বলেই এতোটা সময় লেগেছে তাও পাকিস্তানি না কি লতা বলে ওটা লাগানোর পরে।

জীবনে প্রথম ট্রেকিং ছিলো। আগের রাতে পিৎজাহাট থেকে এসে আর রাতে খাওয়া হয় নি। সকালের নাস্তা বলতে চা সিঙ্গারা। উঠার সময় একটা ঝরনায় মাথা ভিজিয়ে নিলাম। আধাঘন্টা পাহাড় ভাঙার পর মস্তিষ্ক সিগনাল দেয় ভেতরে মাল নাই কোথা থেকে সাপ্লাই দেবো! আমি পানি পান করতে করতে বললাম, মানসিক শক্তি বলেও একটা শক্তি আছে মস্তিষ্ক সেটাকে তুমি উপেক্ষা করতে পারো না! ঘামের মিছিল বাড়তেছে ক্রমান্বয়ে। শিব মন্দিরে গিয়ে সেবায়েতের ব্যবহারে কলিজা শীতল হয়ে গেলো। এতো উপরে কষ্ট করে জলের বোতল ভরে রেখেছে, ভাবলাম খিচ দিয়া টাকা নিবে। সে উল্টো বলে, এখানে যা আছে সবই তোমাদের বাবা, আমার কিছু নেই। আহা শান্তি! চন্দ্রনাথের কাছাকাছি এসে ভাগ্যিস একটা দোকান ছিলো। সেখান থেকে আবার পানি, প্রাণ frooto খেয়ে অনেকসময় রেস্ট নিলাম। চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়া হয় নি। বাম দিকে কালী মন্দিরের খোঁজে প্লাবন দার সাথে আমরা আরো দশজন হাঁটা শুরু।

এবারের পথগুলো আরো সরু এবং কখনো নাইন্টি ডিগ্রিতে দাঁড়ানো। দশ টাকার বাঁশের লাঠি যে উপকার করলো তা টাকায় হিসেব হয় না। পুরনো ট্রাকাররা বিভিন্ন খুনের, ছিনতাইয়ের ইতিহাস তুলে মনে ভয়ের সঞ্চার করতে লাগলো। পুরো পাহাড়ে আমরা এগারজন। নিচে তাকালে ধু ধু গাছপালা। হঠাৎ মনে হলো আমরা যেখানে যেতে চাইছি সে পথ হারিয়ে অন্য পথে ঢুকে গেছি। ট্রাকিং গুরু প্লাবন দাকে জিজ্ঞেস করলাম দাদা আর কতোদূর। উত্তর আসলো, "জানি না দাদা। " আসল রোমাঞ্চ তো কেবল শুরু। হাঁটছি পাহাড়ের বুকে অথচ জানি না কোথায় যাচ্ছি এরচেয়ে আর রোমাঞ্চকর ব্যাপার কি হতে পারে।

এবার হাঁটার পথ ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে। উপরে উঠার পথ খুব একটা নেই। তাই এবার ক্লান্তিহীন। মধ্যিপথে আমলকী গাছে হামলা দিলো কয়েকজন। একেবারে সতেজ প্রাকৃতিক আমলকী। মাঝে মাঝো কোন শব্দ শুনলে মনে হয় এই বুঝি ছিনতাইকারী পিস্তল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো! হাঁটতে হাঁটতে পথ শেষ! এখন পানির পথ। টেনশনে পড়ে গেলাম আবার যদি পেছনে ফেরতে হয় একই পথে তবে আমার পক্ষে আজ ঘরে ফেরা সম্ভব নয়।

বেয়ার গ্রেলস বলেছেন, পাহাড়ে যদি কোন পথ খুঁজে না পাও তাহলে পানির পথ ধরে হাঁটতে থাকবে সেটা তোমাকে একটা গন্তব্যে নিয়ে ঠিকই পৌঁছাবে। বেয়ার মামার কথামতো সবাই পানি পথে হাঁটতে লাগলাম। আমার ভালোই লাগে এখন হাঁটতে। মাঝে মাঝে সেল্ফি খিচি রাসেল আর নেপালিস সুমিত সিং সহ। হাঁটতে হাঁটতে যেখানে পৌছাইলাম সেটা ছিল অবাক করার মত ঘটনা। আমরা যেখান থেকে ট্রেকিং শুরু করছি তার ঠিক বাম পাশে দিয়ে এসে উঠলাম। পিছনে ফেরে তাকিয়ে দেখলাম এতো বিশাল পাহাড় আমি পাড়ি দিয়ে আসলাম কীভাবে হে ঈশ্বর!

ভিডিও দেখুন (সীতাকুন্ড)


 ------
২৭ অক্টোবর ২০১৬